জাল স্ট্যাম্প ছড়িয়ে পড়ছে সরকারি-বেসরকারি দফতরে, গ্রেফতার ৪
২৫ জুন ২০২১ ১৫:৫২
ঢাকা: জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরির অভিযোগে রাজধানী ও নারায়ণগঞ্জে বিশেষ অভিযান চালিয়ে চার জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পুলিশ বলছে, দেখতে হুবুহু আসল রেভিনিউ স্ট্যাম্পের মতো হওয়ায় সহজেই সরকারি-বেসরকারি দফতরে ছড়িয়ে পড়ছে গোপন কারখানায় তৈরি এসব জাল স্ট্যাম্প। শক্তিশালী সিকিউরিটি সিস্টেম এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভাব থাকায় এর সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা সহজে সম্ভব হয় না। যার ফলে জাল স্ট্যাম্পের প্রচলন ও ব্যবহারে বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
চার জনকে গ্রেফতারের পাশাপাশি ২০ কোটি ২ লাখ ২৪ হাজার টাকা সমপরিমাণের ১৩ লাখ ৪০ হাজারটি জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি ও এসব তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে ডিবি।
গ্রেফতাররা হলেন, চক্রের মূলহোতা মো. আবু ইউসুফ ওরফে পারভেজ ওরফে রানা, আতিয়ার রহমান সবুজ, নাসির উদ্দিন ও নুরুল ইসলাম ওরফে সোহেল।
শুক্রবার (২৫ জুন) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একটি টিম গত বৃহস্পতিবার (২৪ জুন) দিবাগত রাত ও শুক্রবার (২৫ জুন) ভোরে বিশেষ অভিযান চালায়। অভিযানে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মাতুয়াইল দক্ষিণপাড়া এলাকার শাহ আলমের বাসার নিচতলায় জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি প্রস্তুতকারী গোপন ছাপাখানা আবিষ্কার ও সিলগালা করা হয়। এসময় বিভিন্ন মূল্যমানের ১৩ লাখ ৪০ হাজার পিস জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প, ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের ১৯ হাজার ৪৮০টি জাল কোর্ট ফি, জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প বিক্রির নগদ ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ১১৪ গ্রাম স্বর্ণালঙ্কার, ৮টি মোবাইল ফোন, একটি পেনড্রাইভ, ডাক বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১১টি সিল, ২টি স্ট্যাম্প পরীক্ষার ইলেকট্রিক মেশিন, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের রশিদের কপি ৩০০ পাতা, একটি বড় প্রেস মেশিন, দুইটি কাটিং মেশিন, একটি ডাই কাটিং মেশিন, একটি পোলার পেপার কাটিং মেশিনসহ ১০০ কোটি টাকা সমপরিমাণের জাল স্ট্যাম্প তৈরির কাগজ, বিভিন্ন ব্যাংকের ১ কোটি ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকার ১৮টি চেকের পাতা জব্দ করা হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে হাফিজ আক্তার বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ২০১৭ সাল থেকে সীমিত পরিসরে চক্রটি কালার প্রিন্টার ব্যবহার করে রেভিনিউ স্ট্যাম্প বিক্রি করে আসছিল। ২০১৯ সালে জার্মানির তৈরি মেশিন কিনে রাজধানীর মাতুয়াইলে কারখানা স্থাপন করে বড় পরিসরে ব্যবসা শুরু করে। তিনটি পর্যায়ে তারা এই জালিয়াতি ব্যবসা করে আসছিল। সুদক্ষ অপারেটরের মাধ্যমে গোপন ছাপাখানায় বিভিন্ন মূল্যমানের স্ট্যাম্প ছাপায় তারা।
দ্বিতীয় পর্যায়ে তারা জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্পগুলো হোলসেল মার্কেট ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের দেয়। এরপর তৃতীয় পর্যায়ে হোলসেলারদের মাধ্যমে রিটেইলারদের মাধ্যমে সেটি গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যায়। এই জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে, সরকারি ও বেসরকারি দফতর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, মার্কেট বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন পোস্ট অফিস এমনকি আদালতেও ব্যবহার হচ্ছে। এতে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।
পোস্ট অফিসের কেউ এই চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে কি না জানতে চাইলে হাফিজ আক্তার বলেন, আমরা প্রাথমিক তদন্তে এখনও পোস্ট অফিসের কারও সংশ্লিষ্টতা পাইনি। তবে গ্রেফতার ৪ জনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
তিনি বলেন, তাদের ব্যবহৃত মেশিনে ঘণ্টায় ৫ হাজার রেভিনিউ স্ট্যাম্প ছাপানো যেত। তবে হুবহু ও কালার ফরমেশন ঠিক রেখে ঘণ্টায় এক থেকে দেড় হাজার রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরি করতে পারে। যা সাধারণ মানুষ ধরতে পারবে না। তাদের তৈরি করা জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প সারাদেশেই সরবরাহ হয়। আর এই স্ট্যাম্প হাতে হাতে নয়, অফিস টু অফিসে নগদ টাকায় বিক্রি ও সরবরাহ হতো। কেউ স্ট্যাম্পের দিকে বিশেষ খেয়ালও রাখে না। কোনো সংস্থার বা প্রতিষ্ঠানের বিশেষ নজরদারিও নেই।
এই জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ব্যবহারকারীরা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না জানতে চাইলে হাফিজ আক্তার বলেন, জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ব্যবহারের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার। সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। তবে এই জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ব্যবহারকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না তা এখনই বলা সম্ভব নয়।
হাফিজ আক্তার বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে চক্রের চারজন সদস্যকে গ্রেফতার করেছি। তবে অভিযানকালে যেহেতু শত কোটি টাকা সমমূল্যের জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরির কাগজপত্র ও সরঞ্জাম পেয়েছি এবং সঙ্গে ২০ কোটি টাকা মূল্যের তৈরি করা স্ট্যাম্প পেয়েছি, তাই আমাদের ধারণা এ চক্রের সঙ্গে আরও অনেকেই জড়িত রয়েছে। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় একটি নিয়মিত মামলা হয়েছে।
সারাবাংলা/ইউজে/এসএসএ