বঙ্গবন্ধু: জনতার পাঠশালায় জীবনের দীক্ষা নেওয়া তাত্ত্বিক
২৫ জুন ২০২১ ১৯:১৫
বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানই একমাত্র নেতা, যিনি একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। আর সেই রাষ্ট্রটি হলো আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের শোষণ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের দিকে এই স্বপ্নের যাত্রা অতো সহজ ছিল না। বুলেট-বোমা উপেক্ষা করে বাঙালি জাতিকে সঙ্গে নিয়ে সেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এর আগে আরও অনেক নেতাই এই স্বপ্ন দেখেছেন, কিন্তু তারা কেউ সফলকাম হননি। কেউ যা পারেনি, বঙ্গবন্ধু তাই পেরেছেন। এর গোপন রহস্য হলো মানুষের ভালোবাসা। বাংলার ধূলিকণা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে ফেলেছিল। কারণ— ছোট বেলায় যেমন তিনি ব্যক্তি-মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় পাশে থাকতেন, তেমনি পরিণত বয়সে বাঙালি জাতির দুঃখদিনের নিত্য সঙ্গী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দুঃখী মানুষের নেতা।
জীবনের পাঠশালায় মানুষ অধ্যয়ন করে রাজনীতির শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যার ফলে তিনি হয়ে ওঠেন মুক্তিকামী বাঙালির একমাত্র কণ্ঠস্বর এবং বাঙালি জাতির পিতা। দেশ ঘুরে ঘুরে মানুষ জোগাড় করাই ছিল তার নেশা। হ্যাঁ, জাতির মুক্তির জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য, মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন তিনি। শুনেছেন তাদের কষ্টময় জীবনের কথা। শুনিয়েছেন মুক্তির আশার বার্তা। বাংলার গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে তিনি রাজনীতির ইমারত গড়ে তুলেছিলেন। তাই তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। আর তাই তার সবলতা যেমন মানুষকে ভালোবাসা, তেমনি দুর্বলতাও মানুষকে ভালোবাসা।
গ্রামের মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা শেখ মুজিব ছোটতেই খুব কাছ থেকে দেখেছেন গণমানুষের জীবন। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে রাজনৈতিক আদর্শ ঠিক করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর সেই আদর্শটি হলো- গরিবের মুখে হাসি ফোটানো। তিনি এই আদর্শ কখনো ত্যাগ করেননি। সাধারণ মানুষের পক্ষ কখনো ত্যাগ করেননি তিনি, ত্যাগ করার কথাও ভাবেননি। একসময় গরিব মুসলমানদের ভাগ্য ফেরানোর আশায় পাকিস্তান চেয়েছেন, আবার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই যখন তিনি শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব বুঝতে পারলেন, সঙ্গেসঙ্গেই গরিব বাঙালির চূড়ান্ত মুক্তির পক্ষে অবস্থান নেন। ফলে পাকিস্তানিরা তার ওপর জেল-জুলুম শুরু করে।
কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখছেন, ”পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরেই ১৯৪৮-এ যখন আমাকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেফতার করল, আবার ১৯৪৯ সালে গ্রেফতার করে ১৯৫২ সালে ছাড়ল, তখন আমার মা আমাকে জিজ্ঞাসা করল- ‘বাবা, তুই তো পাকিস্তান পাকিস্তান করে চিৎকার করেছিস, কত টাকা নিয়ে খরচ করেছিস– এদেশের মানুষ তো তোর কাছ থেকেই পাকিস্তানের নাম শুনেছিল, আজ তোকেই সেই পাকিস্তানের জেলে কেন নেয়’।” সহজ-সরল মাকে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব তিনি দিতে পারেননি অথবা দেননি। তার গরিবমুখী, বাঙালিমুখী অবস্থানের কারণেই যে তাকে শাসকদের রোষাণলে পড়তে হয়েছিল, এটা এখন সবারই জানা।
একাধিকবার তাকে ফাঁসির মঞ্চের মুখোমুখি করা হলেও তিনি আপস করেননি। নিজের সাহস তিনি বাঙালি জাতির মধ্যে সংক্রমিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ডাকে বাঙালি অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে। মরণকে বরণ করেছে হাসিমুখে। তাই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তার জীবনের সেরা ভাষণে শেখ মুজিব অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পেরেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’। বাঙালিকে আসলেই আর কেউ ‘দাবায়ে’ রাখতে পারেনি। পাকিস্তানের শাসন-শোষণের জিঞ্জির ভেঙে বাঙালি স্বাধীনতার রক্ত পতাকা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশেও গরিবের পক্ষে নিজের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত – শোষক এবং শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে’। বঙ্গবন্ধু বিশ্ব রাজনীতিতে তার অবস্থান ঘোষণা করেছিলেন এই বলে, ‘আমাদের পরিষ্কার কথা— আফ্রিকা হোক, ল্যাটিন আমেরিকা হোক, আরবদেশ হোক, যেখানে মানুষ শোষিত, যেখানে মানুষ নির্যাতিত, যেখানে মানুষ দুঃখী, যেখানে মানুষ সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা নির্যাতিত, আমরা বাংলার মানুষ দুঃখী মানুষের সঙ্গে আছি এবং থাকব’। একারণেই বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও বিভিন্ন জুলুমবাজ শক্তির পথের বাধা হয়ে উঠেছিলেন। তাকে হত্যা করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল চক্র এক হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ঘাতক দল তাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে তার গতি রোধ করে দেয়।
কারা এই ঘাতকচক্র? ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যেমন লক্ষ লক্ষ শহীদের জন্ম দিয়েছে, তেমনি বেঈমানও রয়েছে। এখানে রাজাকার-আলবদরও হয়েছে। এসব পরগাছার শিকড় তুলে তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। তা না হলে স্বাধীনতা বিপন্ন হবে। কেউ কেউ আবার অতি বিপ্লবের নামে তলে তলে ষড়যন্ত্র করছে’। বঙ্গবন্ধু শত্রু চিহ্নিত করেছিলেন ঠিকই। পরগাছার শিকড় পুড়িয়ে দেওয়ার কথা বললেও সেই লক্ষ্যে খুব বেশিদূর অগ্রসর হননি কিংবা হতে পারেননি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত হৃদয়বান মানুষ; উদার, মানবিক এবং সংবেদনশীল।
আমৃত্যু বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর রাজনৈতিক ব্রত থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। সদ্যস্বাধীন দেশে গরিবের হক কেড়ে খাওয়া দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কষ্টকর, তা রক্ষা করা তার চাইতেও কঠিন। দেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন।’
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে আরও বলেছিলেন, ‘আমাদের নীতি পরিষ্কার।… দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে হবে।’
সারাবাংলা/এসএসএ