Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ছিনতাইকারী বন্দরের ঝাড়ুদার, মাথার ছায়া কথিত নেতা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৫ জুন ২০২১ ১৯:৪৫

চট্টগ্রাম ব্যুরো: মো. আকাশ নামে ২৪ বছর বয়সী এক যুবক। চট্টগ্রাম বন্দরে অস্থায়ী ভিত্তিতে ঝাড়ুদারের কাজ করেন তিনি। কিন্তু সেটাই তার আসল পেশা নয়। আড়ালে নেতৃত্ব দিচ্ছেন একটি ছিনতাইকারী দলের। ছিনতাইয়ের জন্য আবার আকাশের আছে বিভিন্ন ধরনের কৌশল। গত তিন বছরে শুধু ৩০০টি মোবাইল ছিনতাইয়ের তথ্য দিয়েছে, এমনকি ছিনতাই করেছে হীরা পর্যন্ত।

দুর্ধর্ষ এই ছিনতাইকারী এবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে মামা-স্ত্রী এবং ছিনতাইয়ের কথিত গডফাদারসহ। বৃহস্পতিবার (২৪ জুন) রাতে নগরীর ডবলমুরিং থানার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেছে।

বিজ্ঞাপন

গ্রেফতার বাকি তিন জন হলো— আকাশের স্ত্রী তানিয়া বেগম (২৫), সৎ মামা তাজুল ইসলাম (৪০) এবং ছিনতাইকারী গ্রুপের কথিত গডফাদার আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। উদ্ধার করা হয়েছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ১১টি মোবাইল, ১৬টি লেডিস ব্যাগ এবং ৮ পিস হীরার পাথর ও নগদ ২০ হাজার টাকা।

পুলিশ জানিয়েছে, আকাশের বাড়ি নোয়াখালী। তবে তার জন্ম বন্দর থানার সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায়। গ্রেফতার সবার এলাকাও সেখানে। এদের মধ্যে আনোয়ার নিজেকে বন্দর থানার সোর্স ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দেয়। তবে পুলিশ খতিয়ে দেখে সংগঠনে তার কোনো পদ-পদবি পায়নি।

ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আকাশ গত তিন বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে ঝাড়ুদারের চাকরি করে। কিন্তু অন্তঃত ৫-৭ বছর ধরে ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত। পেশাদার ছিনতাইকারী গ্রুপ তৈরি করেছে নিজেই। আগ্রাবাদ থেকে ইপিজেড পর্যন্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে ছিনতাই করে। প্রথমে ফারজানা নামে আগ্রাবাদের এক গ্যাং লিডারের গ্রুপে ছিল। বছরখানেক ধরে নিজেই তিনজন নিয়ে একটি গ্রুপ গড়ে তুলেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমিই তাকে গ্রেফতার করি। রমজান মাসে জামিন পেয়ে বেরিয়ে আসে। স্ত্রী তানিয়া তাকে প্রতিবার গ্রেফতারের পর দৌড়ঝাঁপ করে জামিন করিয়ে আনে।’

বিজ্ঞাপন

গ্রেফতার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ডবলমুরিং থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) অর্ণব বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘জামিনে বেরিয়ে এসে গত রমজানে আকাশ সিএনজি অটেরিকশার চালায় পর্দা কেটে এক তরুণীর ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনতাই করে। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় আমরা আকাশকে শনাক্ত করি এবং তাকে গ্রেফতার করি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আকাশ জানিয়েছে, বুস্টার জামাল, বুলেট রমজান এবং আকাশ- এই তিনজন মিলে ছিনতাই করে। আকাশই দলের নেতা। তাদের গ্রুপসহ একাধিক গ্রুপের একজন গডফাদার আছে, আনোয়ার। সে নিজেকে পুলিশের সোর্স পরিচয় দেয়। আবার রাজনৈতিক পরিচয় দিয়েও প্রভাব দেখায়। মূলত আনোয়ার এসব ছিনতাইকারীদের শেল্টার দেয় এবং ভাগ পায়।’

গ্রেফতার আকাশের সঙ্গে কথা হয় নগরীর ডবলমুরিং থানায়। আকাশ সারাবাংলাকে জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে মাসে ৬ হাজার টাকা বেতনে সে ঝাড়ুদার হিসেবে চাকরি করে। তিন বছর আগে জামাল ও রমজানের সঙ্গে মিলে ছিনতাইয়ে জড়ায়। বন্দরে চাকরির পাশাপাশি ছিনতাই করত। প্রথমে ফারজানার গ্রুপে তারা কাজ করত। কিন্তু বছরখানেক ধরে ফারজানার সঙ্গে তাদের বিরোধ তৈরি হয়। এরপর আকাশ বাকি দু’জনকে নিয়ে আলাদা গ্রুপ তৈরি করে।

গত তিন বছরে আকাশ তিনবার গ্রেফতার হয়ে জেলে গেছে। তিনবারই জামিনে বেরিয়ে আবার ছিনতাইয়ে জড়িয়েছে। তবে জেলে গেলেও বেরিয়ে এসে আবারও বন্দরের অস্থায়ী চাকরি সে ফিরে পেয়েছে বলে জানায়।

ছিনতাইয়ের কৌশল সম্পর্কে আকাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘টার্গেট থাকে গার্মেন্টসের মহিলা, বাস-ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, সিএনজি অটোরিকশা। অটোরিকশা জ্যামে পড়লে পেছন দিকে উঠে চালার পর্দা কেটে বড় ছোরা ঢুকিয়ে দিই। তখন যাত্রী ভয় পেয়ে যায়। মহিলা যাত্রী থাকলে সুবিধা। ভয় দেখিয়ে মোবাইল, টাকা, ব্যাগ কেড়ে নিই। বাস-ট্রাকের চালক-হেলপারকে বলি, পেরেক ঢুকে চাকা পাংচার হয়ে গেছে। তখন তারা গাড়ি থামিয়ে দ্রুত চাকা পরীক্ষা করতে নামে। হাতে মোবাইল থাকলে কেড়ে নিই। এছাড়া অনেক গার্মেন্টসের মেয়ে অফিস থেকে বের হয়ে হেঁটে বাসায় যায়। তাদের একা অন্ধকার রাস্তায় পেলে আটকে মোবাইল কেড়ে নিই।’

ওসি মহসীন জানান, মূলত চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখী ও বন্দর থেকে বের হওয়া ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, বন্দর-ইপিজেড গন্তব্যের বাস-অটোরিকশা টার্গেট করে ছিনতাই করে আকাশ গ্রুপ।

আকাশের ভাষ্যমতে, গত তিন বছরে কমপক্ষে ৩০০ মোবাইল সে ছিনতাই করেছে। তারা তিনজন কখনও একসঙ্গে, আবার বেশিরভাগ সময় আলাদাভাবেও ছিনতাই করে। যাতে একজন ধরা পড়লে অন্যরা সহযোগিতা করতে পারে।

ওসি মহসীন জানিয়েছে, এত ছিনতাইয়ের ঘটনার পরও আকাশের বিরুদ্ধে খুব বেশি মামলা হয়নি। নগরীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে মাত্র তিনটি মামলা আছে।

আকাশ সারাবাংলাকে জানায়, গত রমজানে ছিনতাই করা এক নারীর ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতরে ৮টি হীরার পাথর পায়। কিন্তু সেগুলো চিনতে না পেরে সে তার সৎ মামা তাজুলকে সেগুলো রাখতে দেয়। যদি বিক্রি করতে পারে, ভাগ দেওয়ার কথাও বলে। কিন্তু তাজুল তাকে সেগুলো যে হীরার পাথর সেটা জানায়নি। মাত্র দুইটি তার স্ত্রীকে দিয়ে বাকিগুলো তাজুল ও আনোয়ার মিলে আত্মসাত করে। অজ্ঞতার কারণে আকাশ এক লাখ ২০ হাজার টাকা দামের একটি মোবাইল সেট মাত্র সাড়ে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করে বলেও জানিয়েছে।

এসআই অর্ণব বড়ুয়া জানান, অভিযানে উদ্ধার করা আটটি হীরার পাথরের মধ্যে দুইটি পাওয়া গেছে আকাশের স্ত্রী তানিয়ার কাছে। বাকিগুলো আনোয়ার ও তাজুলের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে।

আনোয়ার ও তাজুল সম্পর্কে আকাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘তাজুল আমার সৎ মামা। আমি ছিনতাই করি উনি জানেন। কিন্তু উনি ছিনতাই করেন না। মাঝে মাঝে ছিনতাইয়ের মালামাল বিক্রি করে সহযোগিতা করেন। আনোয়ার হোসেন পলিটিক্স করেন। উনি আমরা ঝামেলায় পড়লে হেল্প করেন। ছিনতাই করা মোবাইল-টাকাপয়সা থেকে আমরা উনাকে ভাগ দিই।’

সারাবাংলা/আরডি/এসএসএ

চট্টগ্রাম ছিনতাইকারী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর