১৫ মাস বেতন নেই, রিজেন্ট পাইলটদের মানবেতর জীবনযাপন
২৫ জুন ২০২১ ২৩:৩৫
ঢাকা: বেসরকারি উড়োজাহাজ কোম্পানি রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। যাত্রা শুরু ২০১০ সালে। তবে ধারদেনায় জর্জজিত হয়ে গত বছরের মার্চ থেকে সব ধরনের ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ করে দেয় সংস্থাটি। ওই সময় এয়ারলাইন্সটি তাদের পাইলটদের তিন মাস বিনা বেতনে ছুটি ঘোষণা করে। পরে তাদের ছাঁটাই না করলেও ওই সময় থেকেই দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে আর কোনো বেতন-ভাতা দেয়নি। শুধু তাই নয়, অন্য কোনো এয়ারলাইন্সে চাকরি নিতে চাইলে যে অনাপত্তিপত্র প্রয়োজন, তাদের সেটিও দেওয়া হচ্ছে না। বেসরকারি এই এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানটির পাইলটদের তাই এখন চরম মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আইনি সহায়তার দ্বারস্থ হয়েছেন পাইলটরা।
ভুক্তভোগী পাইলটদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা না পাওয়ায় তারা রিজেন্ট এয়ারওয়েজকে আইনি নোটিশ দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার (২২ জুন) রিজেন্টের ৯ জন পাইলটের পক্ষে উকিল নোটিশটি পাঠিয়েছেন আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহিন এম রহমান । এসব পাইলট হলেন— আজিজ আব্বাসী রফিক, হাবিবুর রহমান, খন্দকার নাজমুল ইসলাম, শামীম আক্তার, চৌধুরী শামসুল ইসলাম, তারেক হাদী, আহমেদ বরকতী খোদা, নূর মোহাম্মদ জুয়েল ও আসিফ মাহমুদ।
রিজেন্ট এয়ারওয়েজকে পাঠানো নোটিশে বলা হয়েছে, দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে বকেয়া বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না পাইলটরা। লাইসেন্স নবায়ন রাখতে প্রতি বছরে দু’টি সিমুলেটর ট্রেনিং করতে হয় তাদের, যার খরচ প্রায় ১৫ লাখ টাকা। এই টাকা এয়ারলাইন্স কোম্পানির দেওয়ার কথা থাকলেও সেই খরচ দেয়নি রিজেন্ট। অন্য কোনো কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অনাপত্তিপত্রও দিচ্ছে না পাইলটদের। শুধু তাই নয়, রিজেন্ট এয়ারওয়েজে যোগ দেওয়ার সময় পাইলটদের কাছে থেকে ব্ল্যাংক চেক নেওয়া হয়েছিল। সেই চেক এখন ফেরত দেওয়া হচ্ছে না।
আইনি নোটিশে আরও বলা হয়েছে, এসব ইস্যুতে পাঠানো আইনি নোটিশের সদুত্তর রিজেন্ট এয়ারওয়েজ না দিলে পরবর্তী সময়ে মামলাসহ অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা নেবেন ভুক্তভোগী পাইলটরা।
রিজেন্ট এয়ারওয়েজের পাইলটদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাত্রা শুরুর পর কিছুদিন ভালোভাবে চললেও একটা পর্যায়ে গিয়ে এয়ারলাইন্স কোম্পানিটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকে। ২০১৯ সালে গিয়ে কিছু ফ্লাইট বন্ধ রাখা হয়। ওই সময় এয়ারলাইন্সটি পাইলটদের জানায়, ফ্লাইট অপারেশনে থাকবে। ওই সময় থেকেই দুয়েক মাস পরপর বেতন দিত রিজেন্ট। ওই বছরে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এভাবেই চলে। এরপর ২০২০ সালের মার্চের পর করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি শুরু হলে তিন মাসের জন্য বিনা বেতনে ছুটি ঘোষণা করা হয়। সেই ছুটি আর শেষ হয়নি ১৫ মাসেও। পাইলটরাও একটাকাও পাননি রিজেন্টের কাছ থেকে।
পাইলটরা আরও জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের মার্চে একসঙ্গে ছয় জন পাইলট যোগ দেন রিজেন্ট এয়ারওয়েজে। তাদের কাছ থেকে রিজেন্ট ৩৫ লাখ টাকার চেক নিয়েছিল নিরাপত্তা জামানত হিসেবে। সেই চেক এখন ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না তাদের। এছাড়া পাইলটদের লাইসেন্স নবায়নের জন্য প্রতিবছর দুইবার করে সিমুলেটর ট্রেনিং করতে হয়। এই ট্রেনিংয়ের জন্য ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়, যা সাধারণত এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলোই দিয়ে থাকে। কিন্তু রিজেন্টের এই পাইলটদের এই টাকা নিজেদের পকেট থেকে খরচ করতে হয়। এখানেও তাদের সঙ্গে বড় ধরনের অন্যায় করা হয়েছে বলে মনে করছেন পাইলটরা।
রিজেন্ট এয়ারওয়েজের এক ভুক্তভোগী পাইলট আসিফ মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, আমি এখন ঋণে জর্জরিত। ১৭ লাখ টাকার ঋণ আমার ঘাড়ে। প্রতি মাসে আমাকে ঋণের কিস্তি দিতে হয়। একদিকে কোনো বেতন-ভাতা নেই; অন্যদিকে নতুন কোথাও যে যোগ দেবো, তার জন্য রিজেন্ট অনাপত্তিপত্রও দিচ্ছে না। পাওনা টাকাগুলো পেলে একটা ব্যবস্থা হতো, হচ্ছে না সেটাও। একদিনে দিন চালাতে পারছি না, অন্যদিকে ক্যারিয়ার ধ্বংসের এখন মুখে। বুঝতে পারছি না কী আছে আমাদের ভাগ্যে।
রিজেন্টের আরেক পাইলট হাবিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ২০১৯ সাল থেকে সমস্যা শুরু। গত বছরের মার্চ পর্যন্ত আমরা ফ্লাই করেছি। দুয়েক মাস পরপর বেতন দিত। ২০২০ সালে মার্চের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো বেতনসহ আর কোনো সুবিধাই পাইনি। এপ্রিল (২০২০ সালের) থেকে যে তিন মাস বেতন ছাড়া ছুটি ঘোষণা করল, সেই ছুটি এখনো চলছে! ১৫ মাস হয়ে গেছে, আমরা কোনো বেতন-ভাতা পাইনি। একটি ইনস্যুরেন্স করা ছিল, সেটি তুলতে গিয়েও আমার জমা টাকা থেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা কম দিয়েছে। আমরা অনেকগুলো মেইল করলেও কোনো উত্তর দেয়নি।
হাবিবুর আরও বলেন, আমাদের তো ট্রেনিংয়ের খরচটাও দেয়নি। বেতন-ভাতা তো দেয়ইনি, তিন তিনটা ঈদ গেল, কোনো খবর নেয়নি। মানসিকভাবে আমাদের একদম ভেঙে দিয়েছে। এই অবস্থায় যে রাস্তায় নেমে হাত পাতব, সামাজিক অবস্থানের কারণে তো সেটিও সম্ভব না!
পাইলটরা বলছেন, পেশাগত দক্ষতার কারণে তারা দেশের সম্পদ। একটি দেশে তো যে কেউ পাইলট হতে পারে না। খুব অল্পসংখ্যক ব্যক্তিই পাইলট হতে পারেন। এ পরিস্থিতিতে সেই পাইলটরা যেভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন, সেটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে তাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তারা এর সমাধান চান, ন্যায় বিচার চান। প্রয়োজনে এ বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ চান তারা।
পাইলটদের পক্ষে উকিল নোটিশ পাঠানো আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহিন এম রহমান সারাবাংলাকে বলেন, রিজেন্ট এয়ারলাইন্সে কর্মরত পাইলটরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ৯ জন পাইলটের পক্ষে এই উকিল নোটিশটি পাঠানো হয়েছে। সিমুলেটর ট্রেনিংয়ের টাকা কোম্পানি না দিয়ে পাইলটদের দিয়ে পরিশোধ করানো হয়েছে, যেটি ঠিক হয়নি। পাইলটদের চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় জামানতের কথা বলে যে চেক নেওয়া হয়েছে, সেটিও বৈধ নয়।
এই আইনজীবী আরও বলেন, এই পাইলটরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তারা এখন অন্য কোনো কোম্পানিতে যেতেও পারছেন না, কারণ তাদের এনওসি (অনাপত্তিপত্র) দেওয়া হচ্ছে না। ফলে এই পাইলটরা পেশাগতভাবে ধ্বংসের মুখে রয়েছেন। তাছাড়া তারা যে মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, এটি তো পরিমাপ করার মতো নয়। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আমরা উকিল নোটিশটি পাঠিয়েছি।
রিজেন্ট এয়ারওয়েজের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আশীষ রায় চৌধুরী। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি বেশ কয়েক মাস আগেই রিজেন্ট এয়ারওয়েজ থেকে চলে এসেছি। যেহেতু আমি আর সেখানে নেই, তাই এ বিষয়ে আমার পক্ষে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব না।’
বিষয়গুলো নিয়ে জানতে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সালমান হাবিবের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। রিজেন্টের আরও একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সারাবাংলা/এসজে/টিআর