জুনের ২৫ দিনেই মাস হিসেবে ২য় সর্বোচ্চ মৃত্যু
২৬ জুন ২০২১ ১০:৪৯
ঢাকা: ২০২০ সালের ৮ মার্চ কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পরে প্রথম মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায় ১৮ মার্চ। এরপরে মাস হিসেবে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী মারা যায় ২০২০ সালের জুলাইয়ে। ওই মাসে মৃত্যু হয় এক হাজার ২৬৪ জনের। তবে ২০২১ সালের এপ্রিলে মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে সেই পরিসংখ্যান। এই মাসে মারা যায় দুই হাজার ৪০৪ জন। তবে চলতি বছরের জুন মাসের প্রথম ২৫ দিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক ব্যক্তি মারা গেছে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে। এ মাসে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৩৫৭ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছে। যা এপ্রিলের পরে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যাওয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ পরিসংখ্যান এখন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বর্তমানে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি চলছে। একদিকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ আর অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিধি পালনের বিষয়ে যে অনীহা তাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমন অবস্থায় পুরো দেশে কমপক্ষে ১৪ দিনের ‘শাটডাউন’ দেওয়ার সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটি।
শুক্রবার (২৫ জুন) স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে ১০৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় এই ১০৮ জনের মৃত্যু দেশে একদিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুরও পরিসংখ্যান।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যুর পরিসংখ্যান
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ। এরপর থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত পর্যন্ত দেশে ১৩ হাজার ৯৭৬ জন মারা গেলেন এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে।
দেশে ২০২০ সালের মার্চ মাসে মোট পাঁচ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে দেশে ১৬৩ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। মে মাসে মারা যান এক হাজার ১৯৭ জন। ২০২০ সালের জুলাইয়ে দেশে এক হাজার ২৬৪ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। এটিই ছিল ২০২০ সালের ১৮ এপ্রিলের আগে মাসের হিসেবে সর্বোচ্চ মৃত্যুর পরিসংখ্যান।
২০২০ সালের আগস্ট মাসে দেশে এক হাজার ১৭০ জন মারা যান। সেপ্টেম্বর মাসে দেশে মারা যান ৯৭০ জন। অক্টোবর মাসে দেশে ৬৭২ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যান। নভেম্বর মাসে দেশে ৭২১ জন ও ডিসেম্বর মাসে মারা যান ৯১৫ জন।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ৫৬৮ জন ও ফেব্রুয়ারি মাসে ২৮১ জনের মৃত্যু হয় কোভিডে। মার্চে ৬৩৮ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। আর ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যায় দুই হাজার ৪০৪ জন। মে মাসে মৃত্যুর সংখ্যা কমে এলেও এক হাজার ১৬৯ জন মৃত্যুবরণ করেন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে।
২০২১ সালের জুন মাসের প্রথম ২৫ দিনে এখন পর্যন্ত দেশে এক হাজার ৩৫৭ জন মৃত্যুবরণ করেছেন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে। যা দেশে মাসের হিসেবে এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর পরিসংখ্যান।
২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ মৃত্যু যে পাঁচ দিনে
২০২১ সালের ১৯ এপ্রিল: এ দিন দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে ১১২ জন মৃত্যুবরণ করেন। যা দেশে এখন পর্যন্ত এক দিনে কোভিড-১০ সংক্রমণ নিয়ে মারা যাওয়ার সর্বোচ্চ পরিসংখ্যান।
২০২১ সালের ২৫ জুন: এ দিন দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে মারা যান ১০৮ জন। যা দেশে এখন পর্যন্ত এক দিনে কোভিড-১০ সংক্রমণ নিয়ে মারা যাওয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিসংখ্যান।
২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল: এদিন দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে ১০২ জন মারা যান। এখন পর্যন্ত একদিনে করোনা সংক্রমণ নিয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর পরিসংখ্যান এটি।
২০২১ সালের ১৬ এপ্রিল: এদিন দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে ১০১ জন মারা যান। এখন পর্যন্ত একদিনে করোনা সংক্রমণ নিয়ে চতুর্থ সর্বোচ্চ মৃত্যুর তথ্য এটি।
২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল: এদিন দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে ১০১ জন মারা যান। এখন পর্যন্ত একদিনে করোনা সংক্রমণ নিয়ে যৌথভাবে চতুর্থ সর্বোচ্চ মৃত্যুর তথ্য এটি।
২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল: এদিন দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে ১০১ জন মারা যান। এখন পর্যন্ত একদিনে করোনা সংক্রমণ নিয়ে যৌথভাবে চতুর্থ সর্বোচ্চ মৃত্যুর তথ্য এটি।
২০২১ সালের ২২ এপ্রিল: এদিন দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে ৯৮ জন মারা যান। এখন পর্যন্ত একদিনে করোনা সংক্রমণ নিয়ে পঞ্চম সর্বোচ্চ মৃত্যুর তথ্য এটিই।
২০২১ সালের ১৪ এপ্রিল: এদিন দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে মারা যান ৯৬ জন। এখন পর্যন্ত এটি একদিনে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ মৃত্যু।
এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী
চলমান করোনা পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যায় সম্প্রতি ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। তবে এই সময়ে কিন্তু সংক্রমণও অনেক বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সংক্রমণ বাড়লেই বয়স্ক মানুষদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। যারা অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত, তাদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। আর বয়স্ক এবং এ ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত হলে বরং মৃত্যুর হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তাই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে হবে।’
বিধিনিষেধ থাকুক না থাকুক, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে প্রত্যেককে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিষয়টি ফের মনে করিয়ে দিলেন কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাস্ক পরা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। ভ্যাকসিন দেওয়া হোক, লকডাউন দেওয়া হোক বা আর যাই কিছু করা হোক না কেন— যে বা যারা মাস্ক পরবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে, তাদের কিন্তু সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কম। আবার তারা নিজেরা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তাদের কাছ থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকিও কম থাকবে। প্রত্যেককেই যদি স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করানো সম্ভব হয়, তাহলেই কেবল সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব।’
এ দিকে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে বর্তমানে সংক্রমণ বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও। আর তাই রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ও জনগণের জীবনের ক্ষতি প্রতিরোধ করার জন্য কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সারাদেশে কমপক্ষে ১৪ দিন সম্পূর্ণ শাটডউন দেওয়ার সুপারিশ করছে। জরুরি সেবা ছাড়া যানবাহন, অফিস-আদালত সহ সবকিছু বন্ধ রাখা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থা কঠোরভাবে পালন করতে না পারলে আমাদের যত প্রস্তুতিই থাকুক না কেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অপ্রতুল হয়ে পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘শাটডাউন মানে হচ্ছে সবকিছু বন্ধ থাকবে, শুধু জরুরি সেবা ছাড়া। অফিস-আদালত, বাজারঘাট, গণপরিবহনসহ সব বন্ধ থাকবে। সবাই বাসায় থাকবে।’
শাটডাউন পদ্ধতিতে প্রতিবেশি দেশ ভারতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘দিল্লি এবং মুম্বাইতে শাটডাউন দিয়ে ফলাফল পেয়েছে। সেখানে ছয় সপ্তাহ গণপরিবহন বন্ধ ছিল, এছাড়াও দিল্লিতে আরও ছিল তিন সপ্তাহ। দিল্লিতে প্রতিদিন একসময় ২৮ হাজার শনাক্ত হতেন, কিন্তু এখন সেখানে ১৫০ শনাক্ত হচ্ছেন। মৃত্যুও কমে এসেছে।’
এদিকে, চলমান লকডাউন ও বিধিনিষেধ মানাতে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর হতে অনুরোধ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
প্রতিষ্ঠানটি অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন জানিয়েছেন, সীমান্তবর্তী এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এর বিস্তার ছড়িয়ে পড়ছে। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে মৃত্যু।
তিনি বলেন, ‘সংক্রমণ কমিয়ে আনার জন্য চলমান লকডাউন ও বিধিনিষেধ কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রয়োজনে কঠোর হতে অনুরোধ করা হলো।’
সারাবাংলা/এসবি/একে