ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে নেই পদক্ষেপ, অপেক্ষা অফিস আদেশের
২৭ জুন ২০২১ ১৪:০৫
ঢাকা: আগে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে প্যাডেলচালিত রিকশা ও ভ্যানের প্রচলনই ছিল বেশি। কিন্তু বর্তমানে রিকশা ও ভ্যানগুলোতে প্যাডেলের পরিবর্তে ইঞ্জিন লাগিয়ে চালানো হচ্ছে। ঢাকা শহরে কিছু জায়গায় প্যাডেলচালিত রিকশার দেখা পাওয়া গেলেও দেশের অন্যান্য জায়গায় এরকম রিকশার দেখা মেলাই ভার। বর্তমানে সারাদেশে প্যাডিলচালিত রিকশার জায়গা দখল করে নিয়েছে ইঞ্জিনচালিত রিকশা-ভ্যান এবং ইজিবাইক। এতে সড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও ছিনতাই। এমন পরিস্থিতিতে ইঞ্জিনচালিত রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সম্প্রতি মহাসড়কে এবং রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক বন্ধে সিদ্ধান্তের কথা জানান। এর একদিন পর সড়ক ও সেতুমন্ত্রী আওয়ামী লাগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকার দুই মেয়রকে এই যানবাহনগুলো বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলেন। কিন্তু চারদিন পার হলেও রাজধানীর সড়কে বেপরোয়া ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে দুই সিটি করপোরেশনের অভিযানের কোনো চিত্র চোখে পড়েনি। এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পুলিশও কিছু জানে না।
অথচ ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশনার দুই দিনের মাথায় জেলা শহরগুলোতে ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। বগুড়ার সান্তাহারে ট্রাফিক পুলিশ বুলডোজার ও হাতুড়ি দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোকে গুড়িয়ে দিচ্ছে। এমনকি যেসব কারখানায় এসব রিকশা তৈরি হয় সেসব কারখানার বিরুদ্ধেও অভিযান শুরুর ইঙ্গিত দিয়েছে পুলিশ।
ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে ঢাকায় কোনো উদ্যোগ নেই কেন?- জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের শুক্রবার (২৫ জুন) সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল ডিএসসিসি। এরপর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছিল। কিন্তু কিছু গণমাধ্যমের অসহযোগিতার কারণে সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। আমরাও অভিযান বন্ধ করেছি। ফলে গত একবছরে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা কয়েক হাজার বৃদ্ধি পেয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ধানমন্ডিতে একটি রিকশা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। ওই রিকশাটি সবধরনের নিয়ম অমান্য করে ধানমন্ডির মূল সড়কে চলাচল করছিল। অভিযানের সময় অন্যান্যরা ওইদিন রিকশা না চালালেও ওই ব্যক্তি ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে বের হয়েছিল। ভ্রাম্যমাণ আদালত ওই রিকশাটির মোটর ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু দুয়েকটি গণমাধ্যম ওই রিকশাচালকের আবেগঘন বক্তব্য অন্যাভাবে প্রচার করে। তাদের ওই প্রচারে মনে হয়েছিল যে, ভ্রাম্যমাণ আদালতই অপরাধ করে ফেলেছেন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরণের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফলে অভিযান বন্ধ রাখা হয়।’
সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ঢাকার দুই মেয়রকে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। এই নির্দেশনার পর আপনারা অভিযানের ব্যাপারে কোনো প্রস্তুতি নিয়েছেন কি না? জানতে চাইলে আবু নাসের বলেন, ‘না- এখনো কোনো প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। মেয়র সাহেব এখনও কোনো কিছু জানাননি। মৌখিক নির্দেশনা পেলেও দাফতরিক কোনো আদেশ পাইনি। দাফতরিক আদেশ পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর নির্দেশনাটি সিটি করপোরেশনের সবখানে আলোচনা হয়েছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে কেউ কেউ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলছেন, আবার কেউ কেউ গড়িমসি করছেন, যাতে উদ্যোগটি ভেস্তে যায়। কারণ ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে উত্তোলন করা চাঁদার একটি অংশ সিটি করপোরেশনের বেশ কিছু কর্মকর্তার পকেটে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ হলে এদের ক্ষতি হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবুল বশির মো. তাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক সরকারি সিদ্ধান্তে ডিএনসিসি এলাকায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উত্তরের কোথাও ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক পাওয়া গেলে সেখানে ভ্র্যাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। সরকারের নির্দেশনা মানতে ডিএনসিসি বদ্ধ পরিকর। অভিযান চালিয়ে এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করা হবে।’
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) কৃঞ্চপদ রায় বলেন, ‘ঢাকার সড়কে কি চলবে, কি চলবে না- তার সম্পূর্ন এখতিয়ার দুই সিটি করপোরেশনের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে আমরা আইন প্রয়োগ করি। সিটি করপোরেশন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলে পুলিশ তো সহযোগিতা করেই থাকে। ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে সিটি করপোরেশন কোনো উদ্যোগ নিলে আমরা সহায়তা করবে।’
পুলিশ বলছে, ব্যাটারিচালিত রিকশা রাজধানীর সড়কে শুধু প্রতিবন্ধীরা চালাতে পারবেন- এমন অনুমতি ছিল। কিন্তু রাতের আঁধারে কীভাবে হাজার হাজার রিকশা আসল ভাবতেই অবাক লাগে। কারা তৈরি করছে, কারা পৃষ্ঠপোষকতা করছে- এর কিছুই জানা নেই। তবে কোনো কোনো এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে পুলিশের টাকা নেওয়ার বিষয়টি ডিএমপির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এই রিকশা ব্যবহার করে একজন প্রতিবন্ধী তার চক্র দিয়ে সেগুনবাগিচার এক ব্যবসায়ীকে ছুরিকাঘাত করে ছিনতাই করে। পরে ওই ব্যবসায়ী হাসপাতালে মারা যায়। এই রিকশার বেপরোয়া গতির কারণে খিলগাঁও এলাকায় এক শিশুর মৃত্যু হয়।
যেসব এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে সেসব এলাকার সাধারণ মানুষেরা জানিয়েছেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা দরকার। তারা মনে করেন, অলিগলিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা বেপরোয়া ভাবে চলাচল করে। এতে নারী ও শিশুরা গলির সড়কটুকুও পার হতে পারেন না। এছাড়া বিকট শব্দে হর্ন বাজানো তো আছেই।
লালবাগ এলাকার ইকবাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘জনস্বার্থে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ হওয়া দরকার। তবে হয়তো সরকারের এ উদ্যোগ সফল হবে না। কারণ প্রত্যেক এলাকাতেই সরকার দলীয় সংগঠনের নেতারা এই রিকশার সঙে জড়িত। তাদের টোকেন ছাড়া সড়কে কেউ নামতে পারবে না। ক্ষতি হচ্ছে জনগণের আর পকেট ভরছে নেতা, পুলিশ ও গাড়ির মালিকরা। যে রিকশা চালায় তার আগেও যা ছিল, এখনও তাই।’
গেন্ডারিয়া এলাকার মুদি দোকানি বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘আগে এই সড়কে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতো না। ব্যাটারিচালিত রিকশা আসার পর থেকেই প্রতিদিনই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে। বিকট শব্দে হর্ন বাজানোর কারণে প্রায় দিনই কারও না কারও সঙ্গে মারামারি লাগে। তাই এসব বন্ধ করে প্যাডেলচালিত রিকশা চালু করা উচিত।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম