শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টা, ধমক দিয়েই সমাধান
২৮ জুন ২০২১ ০১:২২
সিরাজগঞ্জ: জেলায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া আট বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে ফরিদুল (৪০) নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় অভিযুক্তকে ধমক দিয়ে সমাধান করার অভিযোগ উঠেছে এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা মো. আব্দুল মান্নানসহ স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। এমনকি মামলা না করা ও সাংবাদিকদের কাছে ঘটনা প্রকাশ না করার জন্য ভয়ভীতিও দেখানো হয়। এমতাবস্তায় মুখ খুলতেও ভয় পাচ্ছেন ভুক্তভোগী শিশুর পরিবার।
সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার ছোনগাছা ইউনিয়নের নওদা ফুলকোচা গ্রামে এই ঘটনাটি ঘটেছে। অভিযুক্ত ফরিদুল ইসলাম একই গ্রামের সামাদ আলীর ছেলে।
এদিকে এ ঘটনার পর প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও সাংবাদিকদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে পালিয়ে যান ধর্ষণের চেষ্টাকারী মো. ফরিদুল ইসলাম। এ ঘটনায় এলাকাজুড়ে আলোচনা সমালোচনা চললেও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও মাতবরগণ সালিশ করার কারণে ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। এলাকার বাকি প্রভাবশালীরা হলেন— মাতবর, রমজান, বারিক ও লোকমান।
ভুক্তভোগী শিশুটির বাবা ও খালা বলেন, গত শুক্রবার (২৫ জুন) দুপুরে শিশুটির বাবা-মা দুজনেই বাইরে থাকার সুবাদে প্রতিবেশী ফরিদুল সবার অজান্তে দুপুর ২টার দিকে শিশুটির বাড়িতে গিয়ে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। এ সময় শিশুটি চিৎকার করলে ফরিদুল তার মুখ চেপে ধরেন এবং ধর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যান। শিশুটি আবারও চিৎকার করতে থাকলে ভিতর থেকে তার ভাবি বের হয়ে আসলে ফরিদুল শিশুটিকে রেখে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে সেদিনই রাত ১১টার দিকে উল্লেখিত নেতা ও মাতবরগণ শিশুটির বাড়িতে বসেই ফরিদুলকে ধমক দিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়ে দেন। তারা ভয়ে এ বিষয়ে মুখ খুলতে পারছেন না বলেও উল্লেখ করেন।
ভুক্তভোগী শিশুটির মা বলেন, সালিশে ফরিদুলকে মাতব্বররা ধমক দিয়ে ও ৫০টি জুতার বাড়ি দেওয়ার রায় দেয়। কিন্তু আমি ভয়ে বলেছি আমার বাড়ির মধ্যে কাউকে মারা যাবে না। পরে তাকে দিয়ে শুধু মাফ চাওয়ানো হয়। আমরা এটা নিয়ে কিভাবে প্রতিবাদ করব? আমাদের তো তাদের সঙ্গে এই সমাজে বসবাস করতে হবে। আবার এগুলো বাইরের মানুষ জানলে মেয়ে বড় হলে বিয়ে দিতে সমস্যা হবে বলেও আমাদেরকে বলা হয়েছে। তাছাড়া সালিশের মধ্যেই অভিযুক্ত ফরিদুলের চাচাতো ভাই লোকমান হুমকি দিয়ে বলেন— যদি তোমাদের জরিমানা হিসাবে ঘর ভর্তি টাকাও দেই তাও এই ঘরে কিন্তু এক টাকাও থাকবে না।
ভুক্তভোগী শিশু বলেন, ‘ফরিদুল আমাকে দুদিন আগেও জোর করে আখ ক্ষেতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। বলেছিল ১০ হাজার টাকা দিবে ও টাঙ্গাইল নিয়ে যাবে। তার দুদিন পরেই আমাকে তার মোবাইলে খারাপ ভিডিও দেখায় ও আমার জামা প্যান্ট খুলে খারাপ কিছু করার চেষ্টা করেন তিনি। আমি চিৎকার করলে প্রথমে মুখ চেপে ধরে। পরে আমি আবার চিৎকার করলে ভাবি বের হয়ে এসে সবকিছু দেখে। পরে ভাবি টিনের বেড়ায় শব্দ করলে পালিয়ে যান তিনি।’
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী শিশুর ভাবি বলেন, আমি তার চিৎকার শুনে বের হয়ে দেখি বারান্দায় পাতা চৌকিতে ফরিদুল তাকে উলঙ্গ অবস্থায় জোর করে ধর্ষণের চেষ্টা করছে। আমি একা থাকায় সবকিছু দেখেও ভয়ে প্রতিবাদ না করে টিনে শব্দ করলে ফরিদুল দৌড়ে পালিয়ে যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শিশুর পরিবারটি অন্য এলাকা থেকে এসে এখানে কয়েকবছর হলো বসবাস করছেন। এলাকাটি মেয়ের নানার বাড়ির এলাকা। এমন একটি জঘন্য ঘটনা ঘটলেও ভুক্তভোগীর পরিবারকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে তাদেরই বাড়িতে ঘটনার দিন রাত ১১টার দিকে স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুল মান্নান, বারিক, লোকমান, রমজানসহ এলাকার কিছু মাতবর ও ছেলের পরিবারের সদস্যরা বসে অভিযুক্তকে ধমক দিয়ে ধর্ষণ চেষ্টার বিচার সম্পন্ন করেন। এখন শিশুটির পরিবারের অনেকেই প্রতিবেদককে তথ্য নিশ্চিত করলেও নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছেন বলেও জানান। এমনকি সালিশে উল্টো শিশুটিকেই মোবাইল চুরির অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়াও এমন ঘটনার বিচার না হয়ে ধামাচাপা দিলে ভবিষ্যতে এমন আরও অপরাধের প্রবণতা বাড়াবে বলেও জানান সচেতন এলাকাবাসী।
শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযুক্তকে কেন ধমক দিয়ে মীমাংসা করলেন— এমন প্রশ্নের ছোনগাছা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুল মান্নান সালিশ করার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, কেউ আমাকে ধর্ষণ চেষ্টা হয়েছে এমন ঘটনার বিবরণ দেয়নি, আমরাও বুঝতে পারিনি। হয়তো ভুক্তভোগীর পরিবার ভয়ে বলেনি। আমি জানতাম না শিশুটিকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
তাহলে সালিশ কি কারণে করলেন এবং ফরিদুলকে কেন ৫০টি জুতার বাড়ি দেবার রায় দিয়েছিলেন— এমন প্রশ্ন করলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তার এই ঘটনার সালিশ করার এখতিয়ার নেই বলেও স্বীকার করেন তিনি।
অভিযুক্ত ফরিদুলের বর্তমান বাড়িতে গিয়ে তার বাড়ি তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে। তার পৈত্রিক বাড়িতে গেলেও কেউ কথা বলতে চাননি। খুঁজে পাওয়া যায়নি সালিশে হুমকি দেওয়া লোকমানকেও। সালিশকারী অন্যান্য মাতবরদের সঙ্গে কথা বলার জন্য চেষ্টা করা হলেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ছোনগাছা ইউনিয়ন পরিষদের স্থানীয় ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. নুরুল ইসলাম বলেন, আমাকে কেউ বিষয়টি জানায়নি। তবে লোক মারফত বিষয়টি জেনেও না জানার মতো আছি। এমন ঘটনা ঘটেছে এটা সত্য। ঘটনাটি কাউকে না জানতে দিয়ে রাত ১২টা ১টার দিকে কিছু মাতব্বরা বসে ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়েছেন। যেহেতু এই ঘটনার বিচার করার এখতিয়ার আমাদের নেই, কিন্তু তারা যদি আমার কোনো সহযোগিতা চায় আমি অবশ্যই তাদের সহযোগিতা করব। এছাড়াও ভুক্তভোগী পরিবারকে আইনের আশ্রয় নেয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
৬নং ছোনগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শহিদুল আলম বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানিনা এবং আমাকে বিষয়টি কেউ অবগত করেনি। আমার কাছে কোনো অভিযোগ আসলে আমি সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাহাউদ্দীন ফারুকী বলেন, এ ধরনের যেকোনো অভিযোগ পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যাবস্থা নেই। বিষয়টি আমাদের কেউ জানাননি বা কোনো অভিযোগও আসেনি। অভিযোগ পেলেই দ্রুত ব্যাবস্থা নেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, এখনতো ৯৯৯’এ ফোন দিলেও আমরা ব্যাবস্থা নিয়ে থাকি। এসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ জানানো উচিত।
সারাবাংলা/এনএস