সাত দিনের ‘কঠোর লকডাউনে’ দেশ
১ জুলাই ২০২১ ১১:৩০
ঢাকা: টানা এক মাস রেকর্ডসংখ্যক রোগী শনাক্ত এবং মৃত্যুর পর করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশে শুরু হয়েছে সাত দিনের ‘কঠোর লকডাউন’। বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) ভোর ৬টা থেকে শুরু হওয়া এই লকডাউন চলবে ৭ জুলাই সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই লকডাউন আরও বাড়তে পারে।
এবারের ‘লকডাউনে’ জরুরি কারণ ছাড়া ঘরের বাইরে বের হলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে নাগরিকদের। ‘কঠোর’ এই ‘লকডাউন’ সফল করতে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, পরিচালনা করা হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রয়েছে সমগ্র দেশ।
জুলাই মাসের প্রথম দিন থেকে কঠোর এ ‘লকডাউন’ শুরু হলেও এর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে গোটা জুন মাস জুড়ে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে কেবল জুন মাসেই লক্ষাধিক মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্য‘ও পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। সর্বশেষ বুধবার (৩০ জুন) দেশে এক দিনে ৮ হাজার ৮২২ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে- যা বাংলাদেশের জন্য নতুন রেকর্ড। এদিন করোনায় মারা গেছে আরও ১১৫ জন। সব মিলিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা এই মুহূর্তে ১৪ হাজার ৫০৩ জন।
করোনা সংক্রমণের এমন পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রান্ত কারগরি কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী দুই সপ্তাহ আগে ঢাকার সঙ্গে বাইরের জেলাগুলোর যোগাযোগ এক রকম বিছিন্ন করা হয়। অতি ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোকে পুরোপুরি লকডাউন করা হয়। কিন্ত তাতে তেমন কোনো ফল হয়নি। লকডাউনের মধ্যেও স্রোতের মত ঢাকা ছেড়েছে মানুষ। যেসব জেলা এবং বিভাগে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সব কিছু তছনছ করে দিচ্ছে ঢাকায় থাকা সেসব জেলার লোকজনও ঢাকা ছেড়ে নিজ জেলায় গেছেন।
‘লকডাউনে’ যা বন্ধ, যা খোলা:
>> সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে।
>> সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) ও সব যন্ত্রচালিত যানবাহন, শপিংমল, মার্কেটসহ সব দোকানপাট বন্ধ থাকবে।
>> বন্ধ থাকবে সব পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্র।
>> জনসমাবেশ হয় এমন সামাজিক (বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান-ওয়ালিমা, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি), রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
>> আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জরুরি পরিষেবার যানবাহন চলাচল করতে পারবে।
>> জরুরি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মচারী ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র প্রদর্শন দেখিয়ে যাতায়াত করতে পারবে।
>> বরাবরের মত পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত যানবাহন নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে।
>> আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চললেও বন্ধ থাকবে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট।
>> বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকেট দেখিয়ে গাড়ি ব্যবহার করে যাতায়াত করতে পারবেন।
>> এ সময় বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থল বন্দর এবং সংশ্লিষ্ট অফিস নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে।
> শিল্প-কারখানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে।
>> কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনা-বেচা করা যাবে।
>> খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাবার বিক্রি (অনলাইন/টেকওয়ে) করতে পারবে।
>> অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনা, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না।
>> নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
>> যারা করোনাভাইরাসের টিকার তারিখ পেয়েছেন, টিকা কার্ড দেখিয়ে তারা কেন্দ্রে যাতায়াত করতে পারবেন।
কঠোর ‘লকডাউনে’র মধ্যে দেশের সব আদালত ৭ জুলাই পর্যন্ত বন্ধ থাকছে। বুধবার (৩০ জুন) সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আদালত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত জানায়।
ব্যাংক খোলা থাকবে সপ্তাহে চার দিন; প্রতিদিন সাড়ে ৩ ঘণ্টা চলবে লেনদেন। বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকও লেনদেনের নতুন সময়সূচি প্রকাশ করে নির্দেশনা দেয়।
প্রথমবার ‘লকডাউনে’ মসজিদ, মন্দিরসহ উপাসনালয়গুলো বন্ধ রাখা হলেও এবার তা খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে এ সময় কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। মার্চের শেষ সপ্তাহে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এর আগে ১৭ মার্চ থেকেই দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। ২৬ মার্চ থেকে সব অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। কিন্তু জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে অন্য অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও মে মাসের শেষ দিকে বিধিনিষেধ শিথিল করা শুরু হয়। টানা ৬৬ দিনের ‘লকডাউন’ উঠার পর ৩১ মে থেকে অফিস খোলার পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচালের অনুমতি দেয় সরকার। ধীরে ধীরে শুরু হয় ফ্লাইট চলাচল। আগস্টে বিনোদন কেন্দ্রও খুলে দেওয়া শুরু হয়।
এ বছরের শুরুতে সংক্রমণের হার কমে যাওয়ায় বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। সরকার স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার পরিকল্পনাও করে। কিন্তু গত মার্চ মাসের শেষে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ পরিস্থিতি নাজুক করে তোলে। এরই পরিপ্রেক্ষতে ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত নতুন করে বিধিনিষেধ জারি করা হয়। তখন ১৮ দফা নির্দেশনা দেওয়া হলেও সেগুলির বেশিরভাগই প্রতিপালন হচ্ছিল না।
অতঃপর ভারতে পাওয়া কোভিডের ডেল্টা ভেরিয়েন্ট সংক্রমণে জুনের মাঝামাঝিতে সীমান্ত জেলাগুলোর পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ে। পরে সেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। তাতে নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপের পথে হাঁটতে হয় সরকারকে।
সারাবাংলা/এজেড/এসএসএ