Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ: ৩ বছরের প্রকল্প ঠেকেছে ৮ বছরে

জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২ জুলাই ২০২১ ০৮:২৯

ঢাকা: জেলায় জেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ের দ্বিগুণ সময় নিয়েও শেষ করতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত অধিদফতর। ৩ বছর মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা ঠেকেছে ৮ বছরে। অর্থাৎ মূল প্রাক্কলিত সময়ের আড়াই গুণেরও বেশি সময় লেগেছে প্রকল্পটি শেষ হতে।

কেবল সময়ই নয়, এর ধাক্কায় ব্যয়ও বেড়েছে কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রকল্পটিতে। দুই দফায় ব্যয় বাড়ানোর ফলে মূল প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি খরচ হয়েছে এই প্রকল্পে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণে প্রকল্পটির এমন চিত্র উঠে এসেছে। কয়েক দিন আগে প্রতবেদনটি চূড়ান্ত করেছে সংস্থাটি।

বিজ্ঞাপন

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন যেসব সূর্যসৈনিক, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থার উন্নয়নে নানা ধরনের কার্যক্রম শুরু করে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ৬৪ জেলায় ৬৪টি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের প্রকল্পটি সরকার হাতে নেয়। ২০১১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি একনেক সভায় অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত অধিদফতরের যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা ছিল ২০১৩ সালের জুনের মধ্যে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটি শেষ করার সম্ভব হয়নি।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে একবছর বাড়িয়ে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ করা হয় প্রকল্পটির। এরপর দ্বিতীয় সংশোধনের সময় আবারও একবছর বাড়িয়ে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বর্ধিত করা হয়। এতেও বাস্তবায়ন শেষ না হলে আন্তঃখাত সমন্বয়ের প্রথম সংশেধনীর মাধ্যমে তিন বছর বাড়িয়ে প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুনে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া প্রাইস কনটিনজেন্সি করা হয় ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত আন্তঃখাত সমন্বয় দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ধরা হয়। অর্থাৎ ৩ বছরের প্রকল্প গিয়ে ঠেকে ৮ বছরে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, মূল ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুযায়ী প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে এর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৩০ কোটি ২০ লাখ টাকায়। এক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ে প্রায় ১০ শতাংশ। পরে সংশোধিত ডিপিপিতে প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ১৫২ কোটি ৬৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। এই পরিমাণ সংশোধিত ডিপিপির চেয়ে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং মূল ব্যয়ের চেয়ে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণ করতে দের হয়েছে। ফলে প্রকল্পের অধীন ভবনগুলো তৈরিতে সময় লেগেছে অনেক বেশি। এছাড়া ঠিকাদারদের সঙ্গে ভবনগুলো নির্মাণের যে চুক্তি ছিল, সেখানেও সময়ক্ষেপণ করেছে ঠিকাদার। সব মিলিয়ে প্রতিটি ভভন নির্মাণে গড়ে ৩ থেকে ৪ বছর বেশি সময় লেগেছে।

আইএমইডি’র প্রতিবেদনে এ বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। সংস্থাটির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, সাধারণত মান একটি সময় ধরেই কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাক্কলিত সময় নির্ধারণ করা হয়। অনেক সময় বাস্তব নানা কারণে সেই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হয় না। এই প্রকল্পটিও ভূমি অধিগ্রহণসহ নানা জটিলতার কারণে সঠিক সময়ে শেষ করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা। তবে এ ক্ষেত্রে আড়াই গুণেরও বেশি সময় লাগাটা একটু অস্বাভাবিক।

প্রকল্পের খরচ বেশি হওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, টাইম ওভাররান (নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় লাগানো) হলে কস্ট ওভাররান (বেশি খরচ) সাধারণত হয়েই থাকে। এ প্রকল্পেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে প্রকল্পের কোথায় কোথায় ত্রুটি ছিল, সেগুলো নিবিড়ভাবে দেখা হয়েছে। এসব বিষয়ে সুপারিশ দিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। একই ধরনের প্রকল্প আগামীতে নেওয়ার ক্ষেত্রে যেন ক্রুটি-বিচ্যুতিগুলো থেকে মুক্ত থাকা যায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেন সচিব।

আইএমইডি’র প্রাতবেদনে বলা হয়েছে, ৬৪টি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনের মধ্যে ৬৩টি ভবন হস্তান্তর করা হয়েছে এবং একটি ভবন (ঢাকা) চলতি মাসেই হস্তান্তর করা হবে। প্রকল্পটি প্রাথমিক অবস্থায় ৪৮ জেলায় বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাব করা হয়। পরে আরও ১৬টি জেলা অন্তর্ভুক্ত করে সারাদেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের সংস্থান রাখা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়কালে যন্ত্রপাতি ও ফার্নিচার কিনতে গিয়ে গণপূর্ত অধিদফতরের রেট শিডিউল দুই বার (২০১১ ও ২০১৪ সালে) পরিবর্তন হয়। প্রতিটি নতুন রেট শিডিউলেই জিনিসপত্রের দাম ছিল আগের রেড শিডিউলের চেয়ে বেশি। ফলে প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়েছে। অন্যদিকে সংশোধনী প্রস্তাবে প্রতিটি ভবনের জন্য কনফারেন্স টেবিল, বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল স্থাপন, বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য, মুক্তিযদ্ধের বই, সিডি, তৈলচিত্র ও ২৮ ইঞ্চি এলইডি/এলসিডি টেলিভিশন কেনার বিষয়গুলো যুক্ত হওয়ার কারণেও ব্যয় বৃদ্ধি পায়।

আইএমইডি’র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ১৫২ কোটি ৬৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। গত এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ১৩৩ কোটি ২৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। প্রাক্কলনের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ৮৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে মূলধনি খাতের ব্যয় ৮৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং রাজস্ব খাতের ব্যয় ৬৭ দশমিক ২৮ শতাংশ।

প্রকল্পের দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবনের পরিকল্পনায় ত্রুটি ছিল। যেমন— নিচতলায় কোনো বাথরুম দেওয়া হয়নি। নিচ তলায় মার্কেটের জন্য যে দোকান নির্মাণ করা হয়েছে, ভবনের সামনের প্রাচীরের কারণে সেই দোকান ভাড়া দিতে সমস্যা হচ্ছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অফিসের জন্য ভবনের তৃতীয় তলায় নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বয়োবৃদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওঠানামার জন্য কোনো লিফট রাখা হয়নি। ভবনের সামনে যানবাহন পার্কিংয়েরও জায়গা নেই। যেসব ভবন ভাড়া দেওয়া যায়নি, সেসব ভবনের কোনো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। অনেক ভবনে এরই মধ্যে ফাটল দেখা গেছে।

আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোনো কোনো ভবনের স্থাপত্য ও ইমারতের নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। বেশিরভাগ ভবনের নির্মাণকালে নির্মাণ সামগ্রীর প্রয়োজনীয় টেস্ট রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। ঠিকাদারের প্রোগ্রাম অব ওয়ার্কের কোনো নথি পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো ভবনের বিভিন্ন স্থানে প্লাস্টারে ফাটল দেখা দিয়েছে। পানি ও বৈদ্যুতিক লাইনে সমস্যা রয়েছে। এছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ফিটিংস, ফার্নিচার ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেদনে আইএমইডির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ করার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পৃথক সময় আলাদা প্রকল্প নেওয়া প্রয়োজন। ম্যাটেরিয়াল টেস্টের জন্য আলাদা বাজেট চুক্তিপত্রে নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। চুক্তি অনুযায়ী নির্মাণ কাজে সময় বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়বিধি অনুসরণ করা প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনের ভাড়াটিয়ারা তাদের সুবিধামতো বিভিন্ন ফ্লোর আর্কিটেকচারাল প্ল্যান পরিবর্তন করছে, এক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে ভবনের মূল নকশা (ডিপিপিতে অনুমোদিত) পরিবর্তন করতে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনসাপেক্ষে করতে হবে এবং অনুমোদনের কপি সংশ্লিষ্ট অফিসে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। ভবন নির্মাণ কাজ শেষ না হলে আসবাবপত্র কেনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স এবং শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাদের পরিবর্তে তাদের সন্তানদের জন্য আয়বর্ধনমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে এবং মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনের আয় থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কল্যাণমূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়া যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে পরামর্শ দিয়েছে আইএমইডি।

সারাবাংলা/জেজে/টিআর

পরিকল্পনা কমিশন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ভূমি অধিগ্রহণ মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর