Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রেকর্ডভাঙা সপ্তাহে জনস্বাস্থ্যবিদেরাই ‘আতঙ্কগ্রস্ত’

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৪ জুলাই ২০২১ ২৩:১৫

ঢাকা: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের জারি করা সাত দিনের কঠোর বিধিনিষেধের চার দিন পেরোলেও তার কোনো সুফল আসেনি। বরং সবশেষ চার দিনেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু ছাড়িয়েছে নতুন রেকর্ড। আর তাতে সবশেষ একসপ্তাহে করোনা সংক্রমণের যে চিত্র দাঁড়িয়েছে, তাতে জনস্বাস্থ্যবিদসহ বিশেষজ্ঞরাই বলছেন পরিস্থিতি ভীষণ আতঙ্কজনক। সংক্রমণের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে এখন করোনার যেসব পরিসংখ্যানকে ‘ভীতিজাগানিয়া’ মনে হচ্ছে, সেসব পরিসংখ্যান ফুলে-ফেঁপে আরও অনেক নতুন রেকর্ড গড়বে।

বিজ্ঞাপন

এ পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমণে লাগাম টানা সম্ভব না হলে তা দেশের চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা করছেন আতঙ্কগ্রস্ত বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, যেকোনো উপায়েই হোক, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর জন্য এরই মধ্যে সরকারের আরোপিত বিধিনিষেধ আরও কমপক্ষে একসপ্তাহ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর বলছে— স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণসহ জনগণকে সচেতন হতেই হবে, এর সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গকে একযোগে এই মহামারি মোকাবিলায় নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

শেষ সপ্তাহের পরিসংখ্যান

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান বলছে, আজকের দিনসহ সবশেষ একসপ্তাহে দেশে ২ লাখ ১৬ হাজার ৭৭৯টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। অর্থাৎ এই সনপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৩০ হাজারেরও বেশি। আর এসব নমুনার মধ্যে ৫৬ হাজার ৫১১টিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৮ হাজার ৭৩টি! অথচ এই সপ্তাহের আগে দেশে কখনো একদিনে ৮ হাজার সংক্রমণ শনাক্তই হয়নি। এই সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হারও ছিল ২৬ দশমিক ০১ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি একশ নমুনায় ২৬ জন ছিলেন করোনা পজিটিভ।

এদিকে, সবশেষ এই সপ্তাহে দেশে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মারা গেছেন ৮৯৩ জন। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ১২৭ জন করে মারা গেছেন এই সাত দিনে। আর এই সাত দিনের মধ্যে শেষ চার দিনে করোনায় মৃত্যু ছিল যথাক্রমে ১৪৩ জন, ১৩২ জন, ১৩৪ জন ও ১৫৩ জন। এই চারটি সংখ্যাই দেশে করোনায় একদিনে সর্বোচ্চ চার মৃত্যুর পরিসংখ্যান।

কী বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলে আসছিলেন, সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে হবে, মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়েই নয়, রাষ্ট্রীয়ভাবেও করোনা নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধ জারির তাগিদ দিয়ে আসছিলেন তারা। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পক্ষ থেকে তো কমপক্ষে ১৪ দিনের সম্পূর্ণ শাটডাউনই ঘোষণার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে অবশ্য ১ জুলাই থেকে সাত দিনের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে সরকার।

বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, গত সাত দিনের পরিসংখ্যান অবশ্যই আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলার মতো। কেবল সংক্রমণ বাড়ছে না, বাড়ছে কোভিডে আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যাও। তাই এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই সারাদেশে কমপক্ষে ১৪ দিন সম্পূর্ণ শাটডউন দেওয়ার সুপারিশ করেছিলাম। আমরা শাটডাউন বলতে বুঝিয়েছিলাম, সব কিছু যে বন্ধ থাকে। সরকার সাত দিনের কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েছে। আমরা আশা করব সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার অবশ্যই এটিকে বাড়াবে। জরুরি সেবা ছাড়া যানবাহন, অফিস-আদালতসহ সবকিছু বন্ধ রাখতে হবে। কঠোরভাবে বিধিনিষেধ পালন করতে না পারলে আমাদের যত প্রস্তুতিই থাকুক না কেন, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা অপ্রতুল হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুন-

প্রতিবেশী দেশ ভারতের উদাহরণ দিয়ে ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, দিল্লি ও মুম্বাই কিন্তু শাটডাউন দিয়ে ফলাফল পেয়েছে। সেখানে ছয় সপ্তাহ গণপরিবহন বন্ধ ছিল, এছাড়াও দিল্লিতে আরও বাড়তি তিন সপ্তাহ বন্ধ ছিল। দিল্লিতে একসময় প্রতিদিন ২৮ হাজার কোভিড সংক্রমণ শনাক্ত হতো, সেটি দেড়-দুইশতে নেমে এসেছে। মৃত্যুও কমেছে। একই অবস্থা মুম্বাইয়ে। একইভাবে জরুরি সেবা ছাড়া বাকি সব বন্ধ রাখার পথে থাকতে হবে আমাদেরও।

চলমান করোনা পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, করোনা সংক্রমণ বাড়লেই কিন্তু বয়স্ক মানুষদের মধ্যেও সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা বাড়বে। যারা অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত, তাদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। আর বয়স্ক ও এ ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যত বেশি করোনায় আক্রান্ত হবেন, মৃত্যুর হার তত বেশি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। গত কয়েকদিনের পরিসংখ্যানেও কিন্তু আমরা সেটিই দেখছি।

ডা. আলমগীর আরও বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকলে ব্যক্তি সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। সরকার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু ব্যক্তি যদি সচেতন হয়ে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে সহযোগিতা না করে, তবে বিপদ বাড়বে। কারণ একজন যদি কোনো এলাকায় সংক্রমিত হয়ে থাকেন তবে তিনি তার পরিবারসহ আশপাশের সবখানে সংক্রমণ ছড়াতে পারেন। ফলে রাষ্ট্র বিধিনিষেধ দিলেও ব্যক্তিতে মাস্ক পরতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। একইসঙ্গে অবশ্যই লক্ষণ দেখা দিলে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চিকিৎসা নিতে হবে।

বিধিনিষেধ থাকুক না থাকুক, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে প্রত্যেককে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিষয়টি ফের মনে করিয়ে দিলেন কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাস্ক পরা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। ভ্যাকসিন দেওয়া হোক, লকডাউন দেওয়া হোক বা আর যাই কিছু করা হোক না কেন— যে বা যারা মাস্ক পরবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে, তাদের কিন্তু সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কম। আবার তারা নিজেরা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তাদের কাছ থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকিও কম থাকবে। প্রত্যেককেই যদি স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করানো সম্ভব হয়, তাহলেই কেবল সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব।’

কী বলছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর

দেশে চলমান কোভিড সংক্রমণ পরিস্থিতি আতঙ্কজনক, সেটি স্বীকার করে নিচ্ছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ প্রতিপালনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

ডা. রোবেদ আমিন বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় করোনার সংক্রমণ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে। সংক্রমণ যেমন বাড়ছে, তেমনি আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে মৃত্যুও।

তিনি বলেন, সংক্রমণ কমিয়ে আনতে চলমান লকডাউন ও বিধিনিষেধ কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও আমরা বলছি, প্রয়োজনে কঠোর হবেন।

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকেরও। সে কারণে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আরও বেশি সময়ের জন্য, প্রয়োজনে আরও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের পক্ষে তিনি। আর বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে মন্ত্রী জনগণেরও সহায়তা কামনা করছেন।

জাহিদ মালেক সারাবাংলাকে বলেন, সংক্রমণ যদি আমরা এখনই নিয়ন্ত্রণ না করতে পারি, তাহলে মৃত্যুও বাড়বে। আর আমাদের প্রস্তুতি যতই থাকুক, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে এত রোগীকে একসঙ্গে চিকিৎসা দেওয়াটাও তো কঠিন হয়ে পড়বে। তাই সবার প্রতি অনুরোধ, বিধিনিষেধ মেনে চলুন। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিধিনিষেধ আরও হয়তো বাড়ানো হবে। সেক্ষেত্রে সরকারকেও সহযোগিতা করুন, নিজে সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থেকে আশপাশের মানুষকেও সুরক্ষিত রাখুন।

মন্ত্রী আরও বলেন, সরকারের একার পক্ষে মহামারি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। সরকারকে সহযোগিতা করে প্রত্যেকে যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে এলে তবেই এই মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

করোনা সংক্রমণ করোনাভাইরাস করোনায় মৃত্যু কোভিড-১৯ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর