বিধিনিষেধেও কিস্তির তাড়া, না দিলেই অপদস্থ
৬ জুলাই ২০২১ ১০:০০
১৮ বছর ধরে রিকশা চালান যশোরের চৌগাছার ফুলসরা গ্রামের আলমগীর হোসেন। রিকশার প্যাডেল ঘুরলেই ছয় জনের সংসারে খাবার জোটে। না হলে দু’মুঠো ভাতও জোটে না। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশজুড়ে কড়া বিধিনিষেধে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে সেটিও। আগে যেখানে দিনে পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা আয় হতো, সেখানে এখন তার দৈনিক আয় নেমে এসেছে এক থেকে দেড়শ টাকায়।
এরকম পরিস্থিতিতে মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে বসেছে এনজিও’র কিস্তি। মাস পাঁচেক আগে এনজিও থেকে ৪৫ হাজার টাকা ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন আলমগীর। আগের পাঁচটি কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করলেও রোজগার কমে যাওয়ায় এখন আর কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। এমন অবস্থায় খাবার জোগাড় করবেন নাকি কিস্তির টাকা পরিশোধ করবেন, সেই দুশ্চিন্তাই কাটছে না আলমগীরের।
সারাবাংলাকে আলমগীর বলেন, ‘কিস্তিওয়ালারা খুব চাপ দিচ্ছে, টাকা দিতেই হবে। টাকা কোথা থেকে দিবো বলেন? ইনকাম না করতে পারলে টাকা কোথা থেকে দিবো।’
আলমগীর আক্ষেপ করে বলেন, ‘পেট চালাতে পারছি না, কিস্তি দিবো কোথা থেকে। আমার সংসারে ছয় জন মানুষ। যে টাকা ইনকাম, তাতে বাজার করেই খেতে পারছি না। কিস্তির টাকা আসবে কোথা থেকে? খুব করুণ অবস্থা আমাদের। দিন কোনোরকমে যাচ্ছে কেটেকুটে। লবণ ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা বহুত কষ্ট।’
কেবল আলমগীর নয়, একই অবস্থা যশোর সদরের চাঁচড়া এলাকার সুফিয়া বেগমের সংসারেও। গাড়িচালক স্বামীর রোজগারে চলে ১২ জনের সংসার। লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় রোজগার বন্ধ। এমন পরিস্থিতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। কিস্তির টাকার কথা তো ভাবতেই পারছেন না।
সুফিয়া বলেন, ‘আমরা খেতে পারছি না, সমিতি দিবো কী করে? আমরা দিন আনি দিন খাই। ঘরে আজকের চাল আছে। কালকে হবে না। তাহলে এই লকডাউনে আমরা কী করে চলবো বলেন?’
আলমগীর, সুফিয়ার মতো এমন পরিস্থিতির শিকার জেলার নিম্ন আয়ের মানুষদের অনেকেই। সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে জাগরণী চক্র, ওয়াইডব্লিওসিএ, উদ্দীপন, আশা, ব্র্যাক, গ্রামীণসহ বেশ কয়েকটি এনজিও এখনো এই কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও ঋণের কিস্তি তুলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভুক্তভোগীদেরও অভিযোগ, কিস্তির টাকা না দিতে পারায় অপমান-অপদস্থ হতে হচ্ছে। তারা সারাবাংলাকে বলছেন, কিস্তির টাকার জন্য এনজিও খুব চাপ দিচ্ছে। না দিতে পারলে গালিগালাজ করে। নিম্ন আয়ের এসব মানুষেরা বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে ঘরে বসে কান্নাকাটি করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছেন না।
অথচ করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় জুন মাসেই সব এনজিও প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি আদায় সাময়িক বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দেয় জেলা প্রশাসন। গত ২৪ জুন জেলা প্রশাসক রফিকুল হাসানের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নির্দেশনার কথা জানানো হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা উপেক্ষা করেই কিস্তির টাকার জন্য কিছু এনজিও নিম্ন আয়ের মানুষদের চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
তবে এনজিওকর্মীরা বলছেন ভিন্ন কথা। গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ ঠিক রাখতেই বাড়িতে যাচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন তারা। তবে কেউ কেউ স্বীকারও করে নিয়েছেন, নিকট অতীতে যারা ঋণ নিয়েছেন, তারা বিধিনিষেধ হোক আর যাই হোক, কিস্তি দেওয়ার শর্ত মেনেই ঋণ নিয়েছেন।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মো. সায়েমুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে কিস্তি আদায় করা চলবে না। বিষয়টি স্পষ্টভাবে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া আছে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ জেলায় কাজ করতে হলে অবশ্যই জেলা প্রশাসকের যে নির্দেশ, তা মেনে এবং মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই কাজ করতে হবে। প্রশাসনের নির্দেশ অমান্য করে কোনো কাজ করা যাবে না।’
সারাবাংলা/এসএসএস