‘রোগীর চাপ সামলাতে’ই গণপদায়ন, বিএমএ বলছে খামখেয়ালি
৬ জুলাই ২০২১ ২২:৪১
ঢাকা: দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের এক হাজার ২৫৩ জন চিকিৎসককে পদায়ন করা হয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে করোনার রোগী বাড়তে থাকায় হাসপাতালে চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন। এ কারণে করোনাকালীন সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে মেডিকেল কলেজগুলো থেকে চিকিৎসকদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) বলছে, মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত খামখেয়ালি ও বাস্তবতা বিবর্জিত।
এদিকে, গণপদায়নের এই আদেশের মধ্যে এমন অনেক চিকিৎসকের নামও স্থান পেয়েছিল, যারা মারা গেছেন। এছাড়া মেডিকেল কলেজগুলোতে আরটি-পিসিআর ল্যাবের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকদের নামও এই তালিকায় ছিল। এ গণপদায়নের তালিকা তৈরিতে মন্ত্রণালয়ের এই ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়। অন্যদিকে পিসিআর ল্যাবের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা হাসপাতালে চলে গেলে ল্যাব চলবে কেমন করে, তা নিয়েও উদ্বেগ দেখা দেয়। পরে অবশ্য ত্রুটি স্বীকার করে এ বিষয়ে নতুন আদেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। বলছে, পিসিআর ল্যাবের দায়িত্বপ্রাপ্তদের জন্য এই আদেশ বলবৎ হবে না।
সোমবার (৫ জুলাই) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে জারি করা আলাদা আলাদা প্রজ্ঞাপনে এসব চিকিৎসককে পদায়নের নির্দেশনা জারি করা হয়। এছাড়াও রোববার (৪ জুলাই) আলাদা এক প্রজ্ঞাপনে বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে নতুন পদায়ন করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনগুলোতে দেখা গেছে, বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে একই মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে, একই জেলার জেনারেল হাসপাতাল বা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিংবা পাশের জেলার হাসপাতালে পদায়ন করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-
১ হাজার ২০০ চিকিৎসককে করোনা ইউনিটে পদায়ন
প্রজ্ঞাপনে ত্রুটি স্বীকার করে ‘কিছু চিকিৎসকের’ পদায়ন স্থগিত
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব জাকিয়া পারভিনের সই করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এসব চিকিৎসকরা করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করবেন। বুধবারের (৭ জুলাই) মধ্যে তাদের নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে হবে। তা করতে ব্যর্থ হলে ৮ জুলাই থেকে এসব চিকিৎসককে বর্তমান কর্মস্থল থেকে অবমুক্ত হিসেবে গণ্য করা হবে।
একবারে হাজারেরও বেশি চিকিৎসকের এমন পদায়নের বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক সারাবাংলাকে বলেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শেই তরুণ চিকিৎসকদের হাসপাতালে পদায়ন করা হয়েছে। কারণ হাসপাতালে কোভিড-১৯ সংক্রমিত রোগীর চাপ আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমানে কর্মরত চিকিৎসকরা এই চাপ সামাল দিতে পারছেন না। তাছাড়াও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিস্থিতিও এই পদায়নের পেছনে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরতদের বিভিন্ন হাসপাতালে পদায়ন করা হয়েছে। কারণ তারা তুলনামূলকভাবে একটু কম চাপে আছেন। অন্যদিকে কোভিড ইউনিটের চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন। তাদের সহায়তা করতেই মেডিকেল কলেজগুলো থেকে চিকিৎসকদের ডেকে আনা হয়েছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের পরে স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগ থেকে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের শিক্ষকতার দায়িত্বরতদের স্বাস্থ্যসেবাতেও দায়িত্ব পালনের অনুরোধ করা হয়েছিল। বর্তমানে দেশে কোভিড সংক্রমণ পরিস্থিতি আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় খারাপ হওয়ার কারণেই আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কোভিড চিকিৎসায় নিয়োজিত করা হয়েছে।
চিকিৎসকদের এমন গণপদায়ন নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে প্রচুর। বিশেষ করে প্রজ্ঞাপনে পদায়নের তালিকায় মৃত ও অবসরে যাওয়া চিকিৎসকদের নামও থাকায় তা সমালোচনার পারদকে উসকে দিয়েছে। প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জীবেশ কুমার প্রামাণিক স্বপনকে ওই মেডিকেল কলেজের হাসপাতালেই বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি গত ৬ জানুয়ারি মারা গেছেন। আবার রংপুর মেডিকেল কলেজের ডা. ফেরদৌস আরা শেখকেও একটি হাসপাতালে পদায়ন করা হয়। তিনি এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন বলে সারাবাংলাকে জানিয়েছেন ওই মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. এ কে এম নুরুন্নবী লাইজু। এছাড়া প্রজ্ঞাপনে কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসককেও পদায়নের কথা বলা হয়েছে।
চিকিৎসকদের সমালোচনার আরেকটি জায়গা ছিল— মেডিকেল কলেজগুলোর আরটি-পিসিআর ল্যাবের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকদেরও এসব প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে হাসপাতালে পদায়ন করা হয়। আবার কোনো কোনো মেডিকেল কলেজে কোনো বিভাগে একজনই চিকিৎসক আছেন। নতুন পদায়ন করা হয়েছে তাদেরও। এসব ক্ষেত্রে মেডিকেল কলেজের সংশ্লিষ্ট ওই বিভাগের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছিলেন চিকিৎসকরা। পিসিআর ল্যাবগুলোও বন্ধ হয়ে গেলে নমুনা পরীক্ষায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করা হচ্ছিল।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জাকিয়া পারভীন (যিনি প্রজ্ঞাপনগুলোতে সই করেছেন) সারাবাংলাকে বলেন, বিষয়টি খুবই বিব্রতকর। তথ্য আপডেট না থাকায় মৃত ও অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন চিকিৎসক তালিকায় চলে এসেছেন। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত। আমরা এসব ভুল সংশোধন করে নতুন প্রজ্ঞাপন ইস্যুর কাজ শুরু করেছি।
পরে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নতুন আদেশ জারি করা হয়। এতে আগের পদায়নের প্রজ্ঞাপনগুলোর ত্রুটি স্বীকার করে নেওয়া হয়। বলা হয়— আরটি-পিসিআর ল্যাবসহ অন্যান্য ল্যাব কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত চিকিৎসক; কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসায় সম্পৃক্ত চিকিৎসক; এবং মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন বিভাগের একমাত্র চিকিৎসক যিনি শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত— তাদের জন্য পদায়নের আদেশ কার্যকর হবে না।
এদিকে একাধিক মেডিকেল কলেজ থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে পদায়ন পাওয়া চিকিৎসকরা বলছেন, প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাদের নতুন কর্মস্থলে পদায়ন করার আদেশ পালন করা হবে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু যেভাবে মেডিকেল কলেজগুলোর বিভিন্ন বিভাগ খালি করে চিকিৎসকদের হাসপাতালে পদায়ন করা হয়েছে, তা বাস্তবতা বিবর্জিত সিদ্ধান্ত।
এমন পদায়নকে ‘অদ্ভুত’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক দুলাল সারাবাংলাকে বলেন, এখানে দেখা যাচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে অনেক গ্রেডের বৈষম্য আছে। যারা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক বা সহকারী অধ্যাপক পদে আছেন, তাদের সদর হাসপাতালের মেডিকেল কর্মকর্তা বা সিভিল সার্জনের অধীনে দেওয়া হয়েছে। এটি গ্রেড বৈষম্য। এমন সিদ্ধান্ত প্রকৃতপক্ষে বাস্তবতা বিবর্জিত।
ডা. এহতেশামুল বলেন, সরকারি প্রক্রিয়ার বদলি সাধারণ বিষয়। কিন্তু তার জন্য পরিকল্পনা থাকতে হবে। যিনি আরটি-পিসিআর ল্যাবের দায়িত্বে রয়েছেন, তাকে অন্য একটি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় পাঠানো বাস্তবতা বিবর্জিত। মাইক্রোবায়োলজি বা অ্যানাটমি বিভাগের কাউকে যদি আইসিইউ চালাতে বলা হয়, সেটি তো কাজের কথা নয়। এগুলো খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর
করোনা ইউনিট কোভিড ইউনিট চিকিৎসকদের পদায়ন মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক