Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মধ্যবিত্তরাও টিসিবির পণ্যের লাইনে, বাড়তি চাপে হিমশিম

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৭ জুলাই ২০২১ ২২:১২

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ১০ বছর আগে অবসরে যান রেলওয়ের হিসাবরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসান। সঞ্চয়ের টাকায় এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, আরেক মেয়েকে পড়ালেখা করাচ্ছেন। ছেলেকে খুলে দিয়েছেন একটি কম্পিউটার সরঞ্জামের দোকান। করোনভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ঘোষিত বিধিনিষেধের মধ্যে কয়েকমাস আগে চালু করা দোকানটি এখন বন্ধ। আয়-উপার্জনের পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। তার বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) স্বল্প মূল্যে পণ্য বিক্রির ট্রাকের সামনে। দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর পেয়েছেন ২ কেজি সয়াবিন তেল আর ১ কেজি মসুর ডাল। তাই নিয়ে বাসায় ফেরেন ৬৮ বছর বয়সী হাসান।

বিজ্ঞাপন

একটি বিপণন প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি অঞ্জন রক্ষিত চলমান বিধিনিষেধের মধ্যে বেকার হয়ে পড়েছেন। তিনিও গিয়েছিলেন টিসিবি’র পণ্য কিনতে। বৃষ্টির মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পর পেয়েছেন ডাল ও চিনি।

এ চিত্র বুধবার (৭ জুলাই) দুপুরে নগরীর আন্দরকিল্লা মোড়ের। সেখানে ট্রাকে করে টিসিবি’র স্বল্প মূল্যের পণ্য বিক্রি করছিল পরিবেশক প্রতিষ্ঠান মেসার্স হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স। সেই পণ্য কিনতে কমপক্ষে ৭০০ মানুষ একসঙ্গে জড়ো হয়েছিলেন। কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি, আবার কখনো হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। এর মধ্যেই কোলের শিশুকে নিয়ে মা, নাতিকে নিয়ে বৃদ্ধ, গরীব-নিম্ন আয়ের লোকজনের পাশাপাশি নিম্ন মধ্যবিত্তদের অনেকেরও ভিড় জমেছিল সেখানে।

টিসিবি ও পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা জানিয়েছেন, বিধিনিষেধ বা কঠোর লকডাউন শুরুর আগে স্বল্প মূল্যের পণ্যের ট্রাকের সামনে এত ভিড় থাকত না। গত ৫ জুলাই থেকে চট্টগ্রামে টিসিবি’র পণ্য বিক্রি শুরু হয়েছে। চলবে ৩০ জুলাই পর্যন্ত। মূলত এবারই নগরী ও জেলা-উপজেলার প্রত্যেক স্পটে স্বল্পমূল্যের পণ্যপ্রত্যাশী লোকজনের ভিড় বেড়েছে। পণ্য কেনার জন্য ভিড় বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিন অর্ধেকেরও বেশি মানুষকে ফিরে যেতে হচ্ছে। আবার অনেককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।

বুধবার দুপুরে নগরীর আন্দরকিল্লা মোড়ে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও পণ্য কিনতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন লোকজন। এসময় সেখানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এছাড়া ভিড় বেশি হওয়ায় স্বাস্থ্যবিধিও ছিল উপেক্ষিত। অনেকের মুখে মাস্ক ছিল না। টায়ার দিয়ে তিন ফুট দূরত্বে দাঁড়ানোর জন্য সারি তৈরি করা হলেও লোক সমাগমের চাপে সেগুলো ভেস্তে যায়।

বিজ্ঞাপন

টিসিবি’র চট্টগ্রামের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে টিসিবির গুদাম থেকে প্রতিদিন ৪৩ থেকে ৪৫ ট্রাক পণ্য বিক্রির জন্য বের হয়। পরিবেশকদের মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরীর ২২টি ট্রাকে ২২টি স্পটে প্রতিদিন চলছে পণ্য বিক্রি। এছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলা, কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলার আরও ২০ থেকে ২২টি স্পটে প্রতিদিন পণ্য বিক্রি করা হয়। প্রতিটি ট্রাকে এক হাজার লিটার তেল, ৭০০ কেজি চিনি ও ৪০০ কেজি মসুর ডাল দেওয়া হয়। প্রত্যেক ক্রেতা ২ কেজি সয়াবিন তেল, ১ কেজি করে মসুর ডাল ও চিনি কিনতে পারেন। চিনি ও মসুর ডালের দাম কেজিপ্রতি ৫৫ টাকা এবং তেলের দাম প্রতি লিটার ১০০ টাকা।

নগরীর বাকলিয়া থেকে পণ্য কিনতে আসা বীমা কর্মকর্তা প্রবীর দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ১২টায় লাইনে দাঁড়িয়ে সাড়ে ৩টায় চাল ও চিনি পেয়েছি। বৃষ্টি পড়ছিল, ভিজে গেছি। কী করব, গত এপ্রিল থেকে বেতন অনিয়মিত হয়ে গেছে। এখন তো অনেকটা বেকার। ঘর ভাড়া দিতে কষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করছি কোনোমতে চালিয়ে নেওয়ার।’

অঞ্জন রক্ষিত সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই লিটার তেল টিসিবি থেকে কিনতে পারলে ১০০ টাকার মতো কম পাই। বাজার থেকে কিনতে গেলে বেশি খরচ হয়। এই লকডাউনের সময় এটা আমাদের জন্য অনেক বড় বিষয়। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগে টিসিবির পণ্য দুয়েকবার কিনেছি। এখন আর চলতে পারছি না। সেজন্য ২-৩ ঘণ্টা কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি।’

মোহাম্মদ হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি একেবারে নিম্নবিত্ত মানুষ। নিতান্ত দায় না হলে টিসিবির পণ্য কিনতে যেতাম না। কিন্তু যারা পণ্য বিক্রি করে, তারা এমন আচরণ করেন যেন মনে হয় আমরা ফকির-ভিক্ষুক। তারা আমাদের দয়া করে ত্রাণ দিচ্ছেন। পণ্য দেয় খুবই ধীরগতিতে। মানুষের যে কষ্ট হচ্ছে সেটা বুঝতে চায় না। ট্রাকে যত পণ্য আনে, অর্ধেক বিক্রির পর তারপর স্লো করে দেয়। পরে সেগুলো নিজেদের লোকজনের কাছে বিক্রি করে বলে আমরা শুনেছি।’

জানতে চাইলে নগরীর আন্দরকিল্লা এলাকার পণ্য বিক্রয়কারী পরিবেশক প্রতিষ্ঠান মেসার্স হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক মো. হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা প্রতিমাসেই বিক্রি করি। অন্যান্য সময় বিকেল ৫টা পর্যন্ত ট্রাক নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেও সব পণ্য বিক্রি করতে পারি না। এখন মানুষের চাপ এমন বেড়ে গেছে যে ট্রাকের সামনে কয়েকশ লোক দাঁড়িয়ে থাকে। শৃঙ্খলা রাখতে পারি না। আমাদের তো এত স্টাফ নেই। সেজন্য একটু ধীরগতি হয়।’

তবে যারা টিসিবি’র পণ্য কিনতে আসছেন, তাদের নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মো. হাসান। তিনি বলেন, ‘সবাই যে অভাবের কারণে পণ্য কিনতে আসছে, এমন না। অনেকে মুদি দোকানি তাদের কর্মচারী দাঁড় করিয়ে দেন। ট্রাক থেকে কিনে আবার দোকানে নিয়ে বিক্রি করে। এতে লাভ বেশি হয়। আবার অনেকে আছেন একবার পণ্য নিয়ে গেছেন, এক ঘণ্টা পর এসে আবার দাঁড়াচ্ছেন। লাইনে থাকলে তো আমাদের পণ্য দিতে হয়। এসব কারণে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে।’

জানতে চাইলে টিসিবি, চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান জামাল উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিধিনিষেধের কারণে চাহিদা বেড়েছে— এটা সত্য। আবার সামনে ঈদুল আজহা। তেলের চাহিদা বাড়তি। কিন্তু আমরা তো নিয়মের বাইরে বেশি পণ্য দিতে পারছি না। লোক অতিরিক্ত, আমরা হিমশিম খাচ্ছি। তবে যতটুকু পণ্য বরাদ্দ থাকে, সেগুলো যেন কোনো অভিযোগ ছাড়াই বিক্রি হয়, সেটা আমরা নজরদারি করছি। প্রত্যেক স্পট থেকে তিন বেলা আমাকে ভিডিও কলের মাধ্যমে বিক্রিটা দেখাতে হয়।’

এদিকে, পণ্য বিক্রিতে অনিয়মের অভিযোগে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে পরিবেশক প্রতিষ্ঠান মেসার্স জননী স্টোরের মালিক হেলাল উদ্দিনের ডিলারশিপ লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া নগরীর কোতোয়ালি থানার ফিরিঙ্গিবাজারের মেসার্স ট্রেড লিংক, বোয়ালখালীর চরণদ্বীপের মেসার্স দিদারুল আলম ও আনোয়ারার তুলাতলির মেসার্স আল আমীন পেইন্টের একটি করে ডিলারশিপ লাইসেন্সও বাতিল করা হয়েছে।

টিসিবি কর্মকর্তা জামাল উদ্দিন বলেন, ‘জননী স্টোরের লাইসেন্স বাতিল করার কারণ তারা টিসিবির পণ্যের সঙ্গে নিজেদের পণ্যও ট্রাকে বিক্রি করছিল। বাকি তিনটি প্রতিষ্ঠানের দুইটি করে ডিলারশিপ লাইসেন্স ছিল। এর একটি করে বাতিল করা হয়েছে।’

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

টিসিবি টিসিবি’র ট্রাক টিসিবির পণ্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর