মিলের পরিত্যক্ত ছাই দিয়ে তৈরি হলো রাস্তা, চলবে ভারি যানবাহনও
৯ জুলাই ২০২১ ০৮:০৯
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: অটোরাইস মিলের পরিত্যক্ত ছাই দিয়ে অভিনব উপায়ে দীর্ঘ এক কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন। হর্টিকালচার সেন্টারের নালা ও জঙ্গলে এখন দৃশ্যমান এই মজবুত রাস্তা। এতে অবাক হয়েছেন অটোরাইস মিলের শ্রমিক, কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয়রা।
পরিত্যক্ত ছাই দিয়ে রাস্তা তৈরি করে সবার প্রশংসা পাচ্ছেন এই কৃষি কর্মকর্তা। দীর্ঘ ১০ মাস ধরে প্রায় ৩ হাজার ট্রাক্টর ছাইয়ের তৈরি রাস্তা এতটাই মজবুত হয়েছে যে, ভারি যানবহন চলাচলেও সক্ষম এই রাস্তাটি। কোনোরকম সরকারি বরাদ্দ ছাড়াই ছাই দিয়ে তৈরি এই রাস্তা দিয়েই হর্টিকালচার সেন্টারে পর্যটন এলাকা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছেন উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন।
বর্তমানে নবাব অটো রাইস মিল, হক অটো রাইস মিল, রাজু অটো রাইস মিল, সেলিম অটো রাইস মিলসহ কয়েকটি অটোরাইস মিলের পরিত্যক্ত ছাই দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে।
অথচ এক বছর আগেও আয়তনে দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের প্রায় ১০ একর জায়গা জঙ্গলের মধ্যে ছিল। ঝোপঝাড় ও জঙ্গলের মধ্যে থাকা এসব জায়গায় ব্যবহার করতে পারতো না হর্টিকালচার কর্তৃপক্ষ। এমনকি প্রায় দক্ষিণ অংশের প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে ঝোঁপঝাড়ের কারণে কেউ যেতেই পারতো না।
গতবছর চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারে যোগ দেওয়ার বিশাল অরক্ষিত এলাকা উদ্ধারে উদ্যোগ নেন উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন। শুরু করেন জঙ্গল পরিস্কার অভিযান। প্রায় ১০ একর জায়গা পরিস্কার হলেও পানির নালা ও রাস্তা না থাকায় কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। তাই উদ্ধার হওয়া জমি ব্যবহার উপযোগী করতে হর্টিকালচার সেন্টারের সীমানা প্রাচীরের পাশ দিয়ে রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা করেন কৃষিবিদ মো. মোজদার হোসেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখলেন, এরপর দীর্ঘদিন অপেক্ষাও করলেন। কিন্তু বরাদ্দ আসেনি রাস্তা নির্মাণের জন্য।
৫-৬ ফুট গভীরতার নালা ভরাট করে দীর্ঘ এক কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করতে প্রয়োজন অন্তত অন্তত ৫০ লাখ টাকা। রাস্তা নির্মাণের জন্য এত টাকা বরাদ্দ পাওয়া যাবে না জেনেও চেষ্টা অব্যাহত রাখেন উপ-পরিচালক। এরপর কৃষিবিদ মোজদার হোসেন চিন্তা করেন জেলার বিভিন্ন জায়গা ও রাস্তার ধারে পড়ে থাকা অটোরাইস মিলের অকেজো, অব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত ছাই দিয়ে রাস্তা তৈরির কথা। সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে ও অন্য কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় গত ১০ মাস ধরে ছাই দিয়ে রাস্তা নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘আর ১ মাসের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যাবে রাস্তা নির্মাণের কাজ।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘আমি এখানে যোগদানের পর দেখেছি মোট ৬৮ একর জমির মধ্যে ১০-১৫ একর জমি জঙ্গলে ঢাকা ছিল। আমরা ওই বিশাল অংশটুকু ব্যবহার করতেও পারতাম না। উপ-পরিচালক জায়গাটি পরিস্কার করার পরিকল্পনা নিলেন। পরিস্কার করার পর আমরা দেখলাম, এখানে যাওয়া আসার রাস্তা নেই, যার কারনে বর্ষার সময়ে পুরো এলাকা পরিস্কার করার পরও পানিতে নিমজ্জিত থাকতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘অটোরাইস মিলের ছাই নেওয়ার পরিকল্পনা আসে ডিজি স্যারের মাথা থেকে। শুধুমাত্র ছাই দিয়ে সীমানা প্রচীরের পাশ দিয়ে দীর্ঘ ১ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে। রাস্তাটি নির্মাণের ফলে প্রায় ৩০ বিঘার অধিক পরিমান জমি ব্যবহার করতে পারবে হর্টিকালচার। যেখানে মাতৃগাছ থেকে বিভিন্ন গাছের চারা উৎপাদন করে তা বাজারজাত করা হবে।’ হর্টিকালচার সেন্টারের ডরমেটরি ও স্টাফদের বাসায় যাওয়ার রাস্তা দুটিও ছাই দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
নবাব অটো রাইস মিলের ছাই বহনকারী ট্রাক্টরের চালক মো. অলি আহমেদ বলেন, ‘অটোরাইস মিলের পরিত্যক্ত ছাইগুলো ফেলার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। তাই আগে আমরা অটোরাইস মিলের ছাইগুলো রাস্তার ধারে ফেলতাম। এতে অনেক মানুষের গালমন্দ শুনতে হতো। কিন্তু নতুন ডিজি স্যার আসার পর এই ছাইগুলো আমরা গত ১০ মাস থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারে এনে ফেলছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা খুব আশ্চর্য হয়েছি, যে এভাবেও রাস্তা তৈরি করা যায়! নিজেরাই প্রতিদিন ছাই ফেলতে আসি, অথচ বর্তমানে আমাদের তৈরি রাস্তা দেখে আমরাই অবাক হয়। গর্ত, নালা, ডোবা ভর্তি করে ছাই দিয়েই তৈরি হয়েছে চমৎকার একটি রাস্তা। একদিকে আমাদের ছাই ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা পেয়েছি, তেমনি অব্যদিনে হর্টিকালচার সেন্টারে মজবুত একটি রাস্তাও তৈরি হয়ে গেছে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, ‘এখানে আসার পরপরই দেখলাম বিশাল জায়গা জঙ্গলে ঢেকে আছে। যা আমরা ব্যবহার করতে পারি না। তাই সেগুলো পরিস্কার করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। পরিস্কার করার পর সেসব জায়গা ব্যবহার ও যোগাযোগের সুবিধা করতে রাস্তার প্রয়োজন পড়ে। এনিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিলেও সাড়া মেলেনি। পরে এর বিকল্প হিসেবে ছাই ব্যবহারের উদ্যোগ নিলাম। কারণ চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রচুর পরিমানে থাকা অটোরাইস মিলের পরিত্যক্ত ছাই তারা বাইরে ফেলে দেয়। যেটি অনেক বিপদজনক। এই ফেলে দেওয়া ছাইকে রাস্তার তৈরির কাজে কিভাবে লাগানো যায় সেই চিন্তা থেকে সব অটোরাইস মিলের মালিকদের চিঠি দিলাম ও দাওয়াত করে বিষয়টি বোঝালাম। তারাও বিষয়টতে সাড়া দিয়ে ছাই দিতে আগ্রহী হয়।’
ছাই দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা নির্মাণ কাজ শেষের পথে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগামী এক মাসের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। ছাই দিয়ে রাস্তা তৈরি করতে দেখে অনেকেই তাদের নিজ জমি বা বাড়ির আশেপাশে ছাই ব্যবহার করে রাস্তা নির্মাণ করছে। হর্টিকালচার সেন্টারের রাস্তা ঘিরে রয়েছে নানা পরিকল্পনা। কাজ শেষ হলে একটু দূরে দূরে পুকুরের চারপাশ দিয়ে মোড় ও দর্শনার্থীদের বসার ব্যবস্থা করা হবে। ছাই দিয়ে তৈরি রাস্তাটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে দর্শনার্থীরা চার চাকার গাড়ি নিয়ে একদিক দিয়ে প্রবেশ করে অন্যদিক দিয়ে বের হয়ে যেতে পারবেন।’
উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন আরও বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের আশেপাশে তেমন বিনোদন কেন্দ্র নেই। তাই হর্টিকালচার সেন্টারের এই এলাকাতে এসে মানুষ যাতে পরিবার নিয়ে একটু প্রকৃতির নির্মল হাওয়া ও বিনোদন পেতে পারে সে লক্ষ্যে রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়েছে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দর্শনার্থীরা পুকুরে লাল শাপলা, দুই ধারে হরেক রকমের ফুল-ফলের গাছপালা দেখতে পাবেন।’
উল্লেখ্য, হর্টিকালচার সেন্টারের ঝোপঝাড় পরিস্কার করতে গিয়ে সেখান থেকে এ বছর উদ্ধার করা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দামি আম সূর্যডিম ও আমেরিকান রেড পালমার জাতের ৩টি আম গাছ।
সারাবাংলা/এমও