চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে করোনা
১০ জুলাই ২০২১ ০৮:৫১
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে শহরতলীর উপজেলাসহ প্রত্যন্ত গ্রামেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। উপজেলাগুলোতে মৃত্যুহারও বেশি। উত্তর চট্টগ্রামে সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে আবার হাটহাজারী উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গ্রামের পরিস্থিতিকে তুলনামূলক উদ্বেগজনক হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। দ্রুততার সাথে চিকিৎসা সুবিধা বাড়াতে না পারলে পরিস্থিতির অবনতি হবে বলে মত তাদের।
এদিকে চট্টগ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, আক্রান্ত হওয়ার পরও হাসপাতালে আসতে দেরি করায় এবং নগরীর তুলনায় গ্রামের লোকজন কম ভ্যাকসিন পাওয়ায় সেখানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সঙ্গে মৃত্যুহারও বাড়ছে।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৩ এপ্রিল প্রথম চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ৯ এপ্রিল প্রথম একজন মারা যান। চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত মোট ৬৩ হাজার ৬৯৬ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে নগরীর বাসিন্দা ৪৯ হাজার ২৮২ জন এবং বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা ১৪ হাজার ৪১৪ জন। এছাড়া করোনায় চট্টগ্রামে মারা গেছেন মোট ৭৫৪ জন। এর মধ্যে নগরীর ৪৮৮ জন এবং বিভিন্ন উপজেলার ২৬৬ জন আছেন।
চট্টগ্রামের উপজেলাগুলোর মধ্যে হাটহাজারীতে সংক্রমণ ও মৃত্যু এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। হাটহাজারীতে এ পর্যন্ত তিন হাজার ৬৯ জনের করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৫৭ জন। রাউজানে ১৭৩০ জন, ফটিকছড়িতে ১৫৬৫ জন, সীতাকুণ্ডে ১৫৫৮ জন, পটিয়ায় ১০৭৫, মীরসরাইতে ৮৯৪, রাঙ্গুনিয়ায় ৮৩৮, বোয়ালখালীতে ৭৭৮, আনোয়ারায় ৬৬৮, বাঁশখালীতে ৬৫৪, চন্দনাইশে ৫৫২, সাতকানিয়ায় ৪৭৮, লোহাগাড়া ৩৬৮, সন্দ্বীপে ২২৭ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।
এ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারী, রাউজান, ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ডে সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। এছাড়া মৃত্যুহারের ক্ষেত্রেও উত্তর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় সবচেয়ে বেশি। সীতাকুণ্ডে ৩৪ জন, রাউজান ও বোয়ালখালীতে ২২ জন করে, ফটিকছড়িতে ২০ জন, পটিয়ায় ২১, সাতকানিয়ায় ১৯, মীরসরাইতে ১৬, রাঙ্গুনিয়ায় ১৪, লোহাগাড়া ১০, আনোয়ারায় ৯, বাঁশখালীতে ও চন্দনাইশে ৮ জন করে, সন্দ্বীপে ৬ জন করোনায় আক্রান্ত অবস্থায় মারা গেছেন।
উত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় আক্রান্তের হার গত ১৫ জুনের পর থেকে বাড়তে থাকে। এর ফলে ফটিকছড়ি উপজেলায় ২৩ জুন থেকে আটদিনের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ ঘোষণা করতে হয় জেলা প্রশাসনকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মহানগরীর বাইরে জেলায় চলতি জুলাই মাসের সাতদিনে আগের মাসের প্রথম সাতদিনের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি রোগী শনাক্ত হয়। ১ জুলাই থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত উপজেলাগুলোতে মোট রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৫৫৭ জন। কিন্তু জুন মাসের প্রথম সাতদিনে শনাক্ত হয়েছিল ৭০১ জন। পুরো জুন মাসে উপজেলাগুলোতে মোট রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৫ হাজার ২৫৯ জন। আর চলতি জুলাই মাসের প্রথম সাতদিনে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় রোগী শনাক্ত হয়েছে ১২৮৭ জন। এ হিসেবে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই জুনের মোট রোগীর ৬৮ শতাংশ শনাক্ত হয়েছে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি সারাবাংলাকে বলেন, ‘উত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় সংক্রমণের হার বেশি। নগরীর চেয়েও উপজেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। এ অবস্থা আর কয়েকদিন থাকলে শহরের হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়বে। রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হবে। শুধু চিকিৎসায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে জনসমাগম, আড্ডা, জটলা- এসব পরিহার করতে হবে। মুখে মাস্ক রাখতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।’
এদিকে রোগী বাড়ার সঙ্গে উপজেলাগুলোতে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। চলতি জুলাই মাসের শুরু থেকে নয়দিনে মোট মৃত্যু হয়েছে ৫৩ জনের। এর মধ্যে ৩৯ জনই বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। বাকি ১৪ জন নগরীর বাসিন্দা। এ হিসেবে গত নয়দিনে চট্টগ্রামে মারা যাওয়া ৭৪ শতাংশই বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা।
সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের কর্মকর্তাসহ চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গ্রামে আক্রান্তরাও শহরমুখী হচ্ছেন। এতে চলতি সপ্তাহ থেকে শহরের হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়তে শুরু করেছে। নগরীর কোনো সরকারি হাসপাতালে এখন আইসিইউ শয্যা খালি নেই। অথচ গ্রামের হাসপাতালগুলোর অনেকগুলোই এখনও খালি পড়ে আছে। দেশে ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম শুরুর পর গ্রামের অনেক মানুষ নানাভাবে বিভ্রান্ত ছিলেন। তাদের অনেকেই টিকা দিতে আগ্রহী হননি। টিকাবঞ্চিত লোকজনই আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের কোভিড ইউনিটের প্রধান ডা. আব্দুর রব মাসুম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গ্রামে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তারা শুরুতে চিকিৎসার বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। একেবারে শ্বাসকষ্ট এসে গেলে তারপর শহরের বড় হাসপাতালে আসছেন। কিন্তু পরিস্থিতি তখন অনুকূলে থাকে না। এজন্য উপজেলাগুলোতে মৃত্যুহার বাড়ছে। যারা টিকা নেননি তাদের শারীরিক জটিলতা বেশি।’
চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে শুক্রবার (০৯ জুলাই) পর্যন্ত ৯৮৩ জন করোনায় আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা রোগী।
মারাত্মক সংক্রমণের এ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে বিশেষ করে উপজেলায় অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থার বিষয়টিও আলোচনায় আসছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, কোভিড বিশেষায়িত চট্টগ্রামের জেনারেল হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই শুধু সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন আছে। চট্টগ্রামের ১৪টি উপজেলার মধ্যে বাঁশখালী, মীরসরাই, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও সন্দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। নগরীর সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা আছে ৪৩টি। উপজেলার কোনো হাসপাতালে নেই আইসিইউ সুবিধা।
উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, হাসপাতালে নিরবিচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ এবং আইসিইউ শয্যা না থাকায় করোনায় আক্রান্ত লোকজন শহরের হাসপাতালমুখী হচ্ছেন। অথচ উপজেলার হাসপাতালগুলোতে অনেক শয্যা খালি পড়ে আছে।
জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটি, চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরের তুলনায় উপজেলায় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যেভাবে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে সেটা উদ্বেগজনক অবশ্যই। যেহেতু আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সুবিধাটা নগরকেন্দ্রিক, উপজেলা পর্যায়ে সেভাবে নেই, সুতরাং এটা অনেক বেশি উদ্বেগ তৈরি করছে। এখন গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি যাতে আরও ভয়াবহ পর্যায়ে না যায়, সেজন্য উপজেলায় হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই সিস্টেম তৈরি করতে হবে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ যদি এটা দ্রুততার সাথে করতে না পারে, সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগকে কাজে লাগানো উচিৎ।’
উপজেলার হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি গ্রামগঞ্জে অক্সিজেন সরবরাহের সুবিধাসংবলিত আইসোলেশন সেন্টার, ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তুলতে হবে বলে মত দিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে গড়ে তোলা প্রথম আইসোলেশন সেন্টারের পরিচালক সুশান্ত বড়ুয়া।
এদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে চট্টগ্রামে সংকটজনক পরিস্থিতি বিবেচনায় বৃহস্পতিবার (০৮ জুলাই) দুপুরে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের অনলাইন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং চট্টগ্রাম জেলায় করোনা মোকাবিলায় দায়িত্বরত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তফা কামাল ছিলেন। সভায় বিদ্যমান চিকিৎসাসেবার চিত্র তুলে ধরেন সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি। এতে আইসিইউ শয্যার সংকটের চিত্র তুলে ধরা হয়।
সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান জানান, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনার চিকিৎসার জন্য শয্যা, আইসিইউ এবং অক্সিজেন সক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারি পর্যায়ে চমেক হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা বাড়ানো হবে। জেনারেল হাসপাতালের অধীনে হলি ক্রিসেন্ট এবং রেলওয়ে হাসপাতাল পুনরায় চালু করার উ্দ্যোগ নেওয়া হবে। বেসরকারি পর্যায়ে মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে পূর্ণাঙ্গ ডেডিকেটেট কোভিড হাসপাতাল হিসেবে তৈরি করার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই হাসপাতালে ৩০টি আইসিইউ শয্যা আছে বলে জেলা প্রশাসক জানান।
সারাবাংলা/আরডি/একে