১২ পিডিও শেষ করতে পারেনি নভোথিয়েটার নিমার্ণের এক প্রকল্প!
১০ জুলাই ২০২১ ১০:৪৪
ঢাকা: উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি কম হওয়ার অন্যতম কারণ ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি। এছাড়া এক পরিচালকের (পিডি) একাধিক প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা। অবশেষে এই দুই বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। এখন থেকে একজন কর্মকর্তা একটি প্রকল্পের দায়িত্বে এবং বার বার প্রকল্প পরিচালক বদলি না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটেছে একটি নভোথিয়েটার নির্মাণ প্রকল্পের ক্ষেত্রে।
এ প্রকল্পে এরইমধ্যে ১১ বার পরিচালক বদলি হয়েছে। এখন দায়িত্ব পালন করছেন একজন। সব মিলিয়ে প্রকল্পটিতে ১২ বারে আট জন পরিচালক দায়িত্ব পালন করলেও এখনও কাজ শেষ হয়নি। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার, রাজশাহী স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পে বিরাজ করছে এ অবস্থা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র।
আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের মেয়াদে ১১ বার পরিচালক পরিবর্তন হয়েছে এবং বর্তমানে একজন প্রকল্প পরিচালক দায়িত্ব পালন করছেন। ১২ জনের মধ্যে নভোথিয়েটারের মহাপরিচালক অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ছয় বার দায়িত্বে ছিলেন। ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের কারণে প্রকল্পটির স্থিতি ও গতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি প্রকল্প নির্ধারিত মেয়াদে শেষ হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হয়েছে।
প্রকল্পটিতে নভোথিয়েটারের মহাপরিচালক আবুল বাশার মো. জহুরুল ইসলাম ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে মোট পাঁচবার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। আর মহাপরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট এক মাস দায়িত্বে ছিলেন। পরে এ বছরের মার্চে আজম-ই-সাদাতকে প্রেষণে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনিই দায়িত্ব পালন করছেন।
এর আগে ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রেষণে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. গোলাম মোস্তফা। ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ওই বছরের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন মো. তাহমিদুল ইসলাম। আর বেনজামিন হেমব্রম প্রেষণে দায়িত্ব পালন করেন ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ওই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২০২০ সালের ৬ জুলাই দায়িত্বে আসেন নারায়ণ চন্দ্র সরকার। তিনি ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব দেওয়া হয় মো. লিয়াকত আলীকে। তিনি ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন।
এর আগে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সারাবাংলাকে বলেছিলেন, ‘একজন ব্যক্তি একটির বেশি প্রকল্পের দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। এ বিষয়ে আমরা একটি নিয়ম তৈরি করেছি। সেই সঙ্গে ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলির বিষয়ে কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। বিষয়টি আমরা গভীরভাবে নজরদারি করছি।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের অনুমোদিত আরডিপিপিতে পণ্য ১৭টি, কার্য ৫টি ও সেবা প্যাকেজ একটিসহ সর্বমোট ২৩টি প্যাকেজ রয়েছে। তার মধ্যে পণ্যের ১৭টি প্যাকেজের মধ্যে ৫টির দরপত্র আহ্বান করাসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। ক্রয় সংক্রান্ত প্যাকেজের দরপত্র দলিল ও কার্যাদেশের বিভিন্ন অংশ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিটি দরপত্র দুটি বাংলা ও একটি ইংরেজি পত্রিকাসহ সিপিটিইউয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে এবং প্রতিটি দরপত্র ক্রয় অনুমোদনের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের বিভিন্ন পণ্য ও নির্মাণ উপকরণের ল্যাব টেস্ট রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, নির্মাণ কার্যক্রমের গুণগতমান বজায় রাখার জন্য প্রতিটি স্টেপে যাবতীয় উপকরণ সিলড অবস্থায় রুয়েট এবং বুয়েট থেকে পরীক্ষা করানো হয়েছে। টেস্টে ফলাফলও সন্তোষজনক। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ৩টি বাহ্যিক অডিট সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। তারমধ্যে এ পর্যন্ত একটি (২০১৭-১৮ অর্থবছর) অডিট করা হয়েছে। কোভিড-১৯ এর কারণে পরবর্তী অর্থবছরগুলোতে অডিট শেষ করা যায়নি। তবে প্রকল্প অফিস গত দুই অর্থবছরের অভ্যন্তরীণ অডিট সম্পন্ন করার জন্য অডিট বিভাগকে পত্রের মাধ্যমে অনুরোধ করেছে।
প্রকল্পের আরডিপিপি ও পরিকল্পনা কমিশনের পরিপত্র অনুযায়ী ২১ মে পর্যন্ত ১৫টি পিআইসি ও ১৫টি পিএসসি সভা আয়োজন করার কথা রয়েছে। তার মধ্যে ১২টি পিআইসি ও ১০টি পিএসসি সভার আয়োজন করা হয়েছে। প্রকল্পের নকশা সংশোধন কিংবা অগ্রগতি নিশ্চিতকরণে এই কমিটির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। প্রকল্পের বাকি সময়ে বেশি সংখ্যক পিআইসি ও পিএসসি সভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্পটির সফল সমাপ্তি নিশ্চিতকরণের জন্য পিআইসি সভাগুলো নিয়মিত আয়োজন করা প্রয়োজন।
আইএমইডির পক্ষ থেকে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের বর্তমান ভৌত অবকাঠামো কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। তবে সমন্বিতভাবে সার্বিক অগ্রগতি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নয়। তাই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রয়োজন হবে বলে প্রতীয়মান হয়। ভবিষ্যতে এ ধরণের প্রকল্প প্রণয়নের আগেই বিদেশি পরামর্শকের উপর নির্ভরশীল না হয়ে আমাদের দেশে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ পরামর্শকের বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। প্রকল্পের সুবিধা ভোগীদের কাছ থেকে প্রকল্পটির উপযোগিতা নির্ণয়ের মত প্রকাশের অবস্থা এখনও হয়নি। তাই স্বল্প পরিসরে এ সংক্রান্ত আর্থ-সামাজিক প্রভাব নির্ণয়ের কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, মহাকাশ বিজ্ঞানের প্রয়োগ যথা যোগাযোগ, আবহাওয়া পূর্বভাস, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, তথ্যপ্রযুক্তি, গ্লোবাল পজিশনিং ইত্যাদি প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারা সরাসরি প্রভাবিত করে। তাই মহাকাশবিষয়ক শিক্ষা তরুণ প্রজন্মের জন্য সাধারণ শিক্ষার একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। মহাকাশ বিজ্ঞানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল দেশের সব বিভাগে নভোথিয়েটারের শাখা প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ জোর দেন। তাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রাজশাহীর শহিদ কামরুজ্জামান পার্কের ২ দশমিক ৩০ একর জমি বরাদ্দ ঘোষণা করা হয় এবং আধুনিক নভোথিয়েটর প্রতিষ্ঠার জন্য ডিপিপি প্রণয়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ফলে প্রকল্পের সূচনা হয়। রাজশাহী নভোথিয়েটার শাখা মূলত জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্য এবং উত্তরবঙ্গের তরুণ প্রজন্মকে বিজ্ঞান শিক্ষার দিকে সচেতন করার পাশাপাশি দেশের নাগরিকদের বিনোদন দেওয়ার জন্য একটি শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান হবে।
আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি মূল পর্যায়ে ২০১৭ সালের জুলাই হতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত (৩৬ মাস) সময়ে বাস্তবায়নের জন্য ২২২ কোটি ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। পরবর্তী সময়ে প্রথম সংশোধনীতে ২০১৭ সালের জুলাই হতে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত (৪৮ মাস) সময় বৃদ্ধি করে ২৩২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২০ সালের অক্টোবরে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১ সালের মে পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় ৪৯ কোটি ৭০ লাখ ৯৫ হাজার টাকা যা মোট প্রকল্প বরাদ্দের ২১ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। অংশভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ যায়, রাজস্ব খাতে মোট ৩৭ কোটি এক লাখ টাকা রয়েছে। এছাড়া চলতি বছরের মে পর্যন্ত আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি ৩ কোটি ৬১ লাখ ৪৬ হাজার টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অপরদিকে মূলধন খাতে মোট বরাদ্দ রয়েছে ১৯৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা এবং ব্যয় হয়েছে ৪৬ কোটি ৯ লাখ ৪৯ হাজার টাকা যা মোট বরাদ্দের ২৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
সারাবাংলা/জেজে/পিটিএম