চট্টগ্রাম ব্যুরো : নিষেধ অমান্য করে এলাকায় নির্মাণ সামগ্রীবোঝাই ট্রাক ঢোকানো নিয়ে এক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও তার পরিবারের ওপর দলবল নিয়ে চড়াও হয়েছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হাসান মাহমুদ হাসনী। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ওই এলাকায় একটি দাওয়াতে গিয়ে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের গাড়ি আটকে যাওয়ার পর হাসনী আওয়ামী লীগ নেতার বাসায় গিয়ে দুই ছেলের গায়ে হাত তোলেন। তাদের হাত থেকে বাঁচতে জাতীয় জরুরি সেবার নম্বর ৯৯৯-এ কল করে পুলিশের সহযোগিতা চাওয়া হয়। উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
শুক্রবার (৯ জুলাই) রাতে নগরীর কোতোয়ালী থানার দেওয়ান বাজার ওয়ার্ডের সাব এরিয়া এলাকায় প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা হাজী আব্দুল মোনাফের নির্মাণাধীন বাড়ির সামনে এ ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ প্রাথমিকভাবে ঘটনার সত্যতা পেয়েছে বলে জানিয়েছে। মারধরের অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হবে বলেও পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, ৭৫ বছর বয়সী হাজী আব্দুল মোনাফ চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নের দুইবারের সাবেক চেয়ারম্যান।
হাসান মাহমুদ হাসনী দেওয়ানবাজার ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত চারবারের কাউন্সিলর। তিনি দুই দফায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে তিনি পরিচিত।
জানতে চাইলে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিভিন্ন অলিগলিতে ভবনের নির্মাণকাজের জন্য সামগ্রী নিয়ে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তায়। এ জন্য গলিতে যানজট সৃষ্টি হয়। দেওয়ানবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসান মাহমুদ হাসনী রাত ১২টার আগে নির্মাণসামগ্রী নিয়ে ট্রাক প্রবেশের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন। গত (শুক্রবার) রাতে দেওয়ানবাজারের খলিফাপট্টিতে একটি দাওয়াতে গিয়ে নির্মাণসামগ্রীর একটি ট্রাকের জন্য রাস্তায় আটকা পড়ে সাবেক মেয়র মহোদয়ের গাড়ি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কাউন্সিলর হাসনী সাহেব ভবন মালিকের বাসায় গেলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। উভয়পক্ষে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে ট্রিপল নাইনে ফোন পেয়ে আমরা সেখানে যাই এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনি।’
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেওয়ানবাজারের খলিফাপট্টিতে চট্টগ্রাম আইন কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক একজন সহ-সভাপতির বাসায় তার প্রয়াত পিতার স্মরণে একটি ধর্মীয় আয়োজনে যোগ দিতে যান আ জ ম নাছির উদ্দীন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে ওই বাসা থেকে বেরিয়ে সাবএরিয়া হয়ে মূল সড়কে আসার পথে নির্মাণ সামগ্রীবোঝাই একটি ট্রাকের কারণে রাস্তায় আটকে পড়ে তার গাড়ি। সড়কের ওপর ট্রাক রেখে নির্মাণ সামগ্রী নামানোর কারণে সেখানে বড় গাড়ি চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে নির্মাণাধীন ভবনের মালিক আব্দুল মোনাফ ও তার ছেলেরা সাবেক মেয়রের গাড়ি আটকে থাকা অবস্থায় দেখে ট্রাক সরিয়ে নেন। তখন নাছিরের গাড়ি চলে যায়। প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট নাছিরের গাড়ি আটকা ছিল।
মোনাফের বড় ছেলে নাসির উদ্দিন সারাবাংলাকে জানান, সাবেক মেয়রের গাড়ি চলে যাবার কয়েক মিনিটের মধ্যে কাউন্সিলর হাসনী কয়েকজন নিয়ে তাদের বাসার নিচে আসেন। তিনি প্রথমে আব্দুল মোনাফের ওপর চড়াও হয়ে রাস্তায় ট্রাক রাখার কারণ জানতে চান। এসময় তিনি অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছিলেন। নাসির ঘটনা ভিডিও করার জন্য মোবাইল বের করলে হাসনী হাতে আঘাত করে মোবাইল ফেলে দেন এবং তাকে চড়-থাপ্পড় দেন। এরপর সেখান থেকে ট্রাক সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে চলে যান।
‘আমার আব্বা নিজেও একজন আওয়ামী লীগ নেতা। ছেলের বয়সী একজনের কাছে অপমানিত হয়ে তিনি কান্না করতে থাকেন। তখন আমি কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা আমাকে পরামর্শ দেন, সাবেক মেয়র নাছির সাহেবের বাসায় গিয়ে যেন আমি অভিযোগ করি। আমি উনার বাসায় যাই। কিন্তু উনাকে পাইনি। পরে আমার আব্বা উনাকে ফোন করে অভিযোগ করেন। তখন উনি আব্বাকে পুলিশের কাছে অভিযোগ করার জন্য বলেন।’
নাসিরের অভিযোগ, রাত ১০টার দিকে ট্রাক থেকে আবারও টাইলস নামানো শুরু করেন তারা। তখন কাউন্সিলর হাসনী ৫০-৬০ জন তরুণ-যুবক নিয়ে তাদের বাসার সামনে আসেন। তাদের চিৎকার, গালিগালাজে সেখানে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। শ্রমিকরা ট্রাক নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান। সাবেক মেয়রের কাছে কেন অভিযোগ করা হয়েছে- বিষয়টি জানতে চেয়ে হাসনী ও তার ছেলে নাসির এবং তার ছোট ভাইকে মারধর করেন তাদের বাবার সামনে। এসময় মোনাফের পরিবারের সদস্যরা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশের সাহায্য চান। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে কাউন্সিলর হাসনী ও তার লোকজন সেখান থেকে সরে যান।
পুলিশের উপস্থিতিতে হাসনীর অনুসারীরা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ও হাসনী এবং আ জ ম নাছির উদ্দীনের নামে স্লোগান দিয়ে এলাকায় মিছিল করেন বলে জানান নাসির উদ্দিন।
‘আমাদের জায়গায় আমরা যখন বাড়ি নির্মাণ শুরু করি, তখন থেকেই হাসনী সাহেবের লোকজন আমাদের বিভিন্নভাবে ডিস্টার্ব করে আসছিলেন। উনারা কয়েকবার আমাদের কাছে চাঁদা চেয়েছেন। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় আমি নিজে গিয়ে উনাকে টাকা দিয়ে এসেছি। এরপরও বেশি টাকার জন্য তারা অজুহাত খুঁজছিলেন। এলাকায় অনেক ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। সব ভবনের সামনে দিনে-রাতে ট্রাক থেকে মালামাল নামানো হলেও শুধু আমাদের বাধা দেন তারা। গতকাল (শুক্রবার) সাবেক মেয়র সাহেবের গাড়ি কয়েক মিনিটের জন্য আটকে পড়াকে ইস্যু বানিয়ে তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে।’- অভিযোগ নাসির উদ্দিনের
নাসিরের এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য একাধিকবার ফোন করা হলেও কাউন্সিলর হাসান মাহমুদ হাসনীর সাড়া পাওয়া যায়নি। আ জ ম নাছির উদ্দীনকে ফোন করেও সাড়া মেলেনি।
জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) বিজয় বসাক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পেয়েছি যে, কাউন্সিলর হাসনী সাহেব একজন আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে গিয়ে উনার সঙ্গে খুবই রুড বিহেভ করেছেন। এটা নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়। তবে বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার আগেই পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।’
নাসিরের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে ঘটনাস্থলে গিয়ে উভয়পক্ষে তর্কাতর্কি এবং উত্তেজনার প্রমাণ পেয়েছি। মারধরের অভিযোগ আমরা তদন্ত করে দেখব।’
মামলা করবেন কি না জানতে চাইলে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় আছি। মামলা করলে আমাদের ওপর আবার কোনো হামলা কিংবা আরও বড় কোনো ঘটনা ঘটতে পারে। তারপরও আমার আব্বার সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’