Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মরিশাসে বাংলাদেশি নারীকে ৯ মাস আটকে রেখে ধর্ষণ, দেশে ফিরে মামলা

শেখ জাহিদুজ্জামান,স্টাফ কসেপন্ডেন্ট
১০ জুলাই ২০২১ ২৩:২৪

ঢাকা: অভাবের সংসারে হাল ধরতে লাখো মানুষের মতো আসমাও (ছদ্মনাম) স্বপ্ন দেখে বিদেশ গিয়েছিলেন। স্বপ্ন পূরণ করতে পূর্ব আফ্রিকার দেশ মরিশাসে কাজের জন্য গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় বাংলাদেশে ফিরে মানবপাচার আইনে মামলা করেছেন আসমা। এর আগে তিনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়ে সাহায্য চেয়েছেন। তবে এখনো কোনো সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ তার।

শনিবার (১০ জুলাই) রাজধানীর রামপুরা থানায় দায়ের হওয়া মামলায় ৮ জনকে আসামী করেছেন তিনি। মামলায় আসামীরা হলেন, গোলাম রাব্বী ইন্টারন্যাশনালের মো. আকবর হোসেন, গোলাম রাব্বী, আকতার হোসেন এবং মোহাম্মদ শাহ আলম, ফোরকান, সিদ্দিক,আসলাম ও ভারতীয় নাগরিক অনিল কোহলি।

জানা গেছে, বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা ছিল ভুক্তভোগী আসমার। সেই সূত্রেই রিক্রুটিং এজেন্সি গোলাম রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল (আর.এল.১০৭৮) এর প্রতিনিধি আকতার ও এজেন্সি মালিক মো. আকবর হোসেন এবং এজেন্সিটির অফিসে কাজ করা দালাল জামাল হোসেনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। আসমাকে বলা হয়, ২৮ হাজার টাকা বেতনে মরিশাসে গার্মেন্টস অপারেটরের কাজ পাবেন তিনি। এরপর জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরোর ছাড়পত্র দিয়ে গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি মরিশাসে পাঠানো হয় আসমাকে।

মামলার এজাহার সূত্র জানা গেছে, ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মরিশাস পৌঁছানোর পর কোম্পানির গাড়িতে করে বিমানবন্দর থেকে তাকে ফায়ার মাউন্ট নামক কোম্পানির অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ফায়ার মাউন্ট টেক্সটাইল কোম্পানিতে হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন আসমা। তবে ঠিকমতো বেতন পরিশোধ করা হতো না।

মরিশাসে অবস্থানরত ওই ফায়ার মাউন্ট টেক্সটাইলের কর্মীদের ক্যান্টিন পরিচালনা করেন মোহাম্মদ শাহ আলম (৪৩) নামের এক বাংলাদেশি। তার  বাড়ি ফেনী জেলায়। এই শাহ আলম এবং তার সহযোগী ফুরকান, সিদ্দিক ও আসলাম একদিন আসমাকে (ছদ্মনাম) কোম্পানির মালিক তাকে পছন্দ করে বলে জানিয়ে একটি অনৈতিক প্রস্তাব দেয়। তাদের এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন আসমা।

এরপর শাহ আলম বিভিন্ন সময় তাকে ভয়ভীতিও দেখাতো বলে এজাহারে উল্লেখ করেছেন আসমা। এতে তিনি উল্লেখ করেন, একদিন শাহ আলম বলেন, ‘কোম্পানির মালিক তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে, তাই তোমাকে মালিকের কাছে যেতে হবে’। এ কথা বলে তাকে ফায়ার মাউন্ট টেক্সটাইলের মালিক অনিল কোহলির বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর মালিকের কক্ষে রেখে বাইরে চলে যায় অন্যরা। আর সেইদিনই ফায়ার মাউন্ট টেক্সটাইলের মালিক অনিল কোহলি তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে বলে এজাহারে উল্লেখ করেন আসমা (ছদ্মনাম)।

ভুক্তভোগী নারীর অভিযোগ, এরপর ভিডিও ধারণ করা আছে এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেখিয়ে শাহ আলম ও কোম্পানির মালিক অনিল কোহলি একাধিকবার ধর্ষণ করেন তাকে। একপর্যায়ে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে মরিশাসের একটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে গর্ভপাত করান শাহ আলম।

এরপর আসমাকে দেশে ফেরত পাঠানোর শর্ত দিয়ে শাহ আলম জানান, তার (আসমার) বাবাকে মরিশাসে আনা হবে। পরে ২৮ হাজার টাকা বেতনে  রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স এম আক্তার এন্ড সন্স এর মাধ্যমে আসমার বাবাকে মরিশাসে নেন মাউন্ট টেক্সটাইল কর্তৃপক্ষ। মূলত আসমাকে দেশে পাঠানো হবে এবং তিনি কোনো অভিযোগ করবেন না— এমন শর্তে গতবছরের নভেম্বরে তার বাবাকে ওই কোম্পানিতে নেওয়া হয়। তার বাবা সেখানে পৌঁছানোর পর তাকে (বাবাকে) তাদের হেফাজতে নিয়ে আসমাকে গত ২৮ ডিসেম্বর অসুস্থ অবস্থায় দেশে ফেরত আসতে দেওয়া হয়। আসমা জানান, দেশে এসে অভিযোগ করার পর তার বাবাকেও সেখানে নজরবন্দী করে মানসিকভাবে নানা নির্যাতন করা হচ্ছে।

তিনি জানান, দেশে ফেরার ঠিক তিন দিনের মাথায় রাতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার বোন দেখে ফেলে তার সেই প্রচেষ্টা ঠেকান। এরপর বড় বোনকে সব বিস্তারিত জানান তিনি। পরে তারা ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে তাকে চিকিৎসাসহ কাউন্সেলিং সহায়তা করা হয়।

আসমার দাবি, মরিশাসে ওই কোম্পানিতে ছয়শরও বেশি বাংলাদেশি নারী কাজ করেন। এদের মধ্যে অনেক নারীকে টার্গেট করে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করেন মোহাম্মদ শাহ আলম, ফুরকান, সিদ্দিক ও আসলাম গং। ফায়ার মাউন্ট টেক্সটাইলের মালিক অনিল কোহলি প্রায়ই নারীদের নিপীড়ন করেন।

ভুক্তভোগী নারী যে এজেন্সি থেকে বিদেশে গিয়েছেন সেই আক্তার এন্ড সন্স-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আল আমিন সারাবাংলাকে বলেন, সরকারি সকল আইনকানুন মেনে তাকে বিদেশে পাঠানো হয়। মরিশাসের বাংলাদেশ হাইকমিশনে তিনি কোনো অভিযোগ দেননি। দেশে ফেরার পরও আমাদের কাছে অভিযোগ করেননি। অন্য কোনো এক মাধ্যমে আমরা ঘটনাটি জেনেছি। এটি নিয়ে আমাদের দেশের মন্ত্রণালয় কাজ করছেন বলে জেনেছি, তারা সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।

এ ঘটনায় আপনাদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তাকে পাঠিয়েছি এটা ঠিক। কিন্তু সেই দেশে পাঠানোর পর ওই কোম্পানিতে কী হয়েছে সেটা আমাদের জানার বিষয় নয়। অভিযুক্ত কোম্পানির মালিক ভারতীয় নাগরিক। আর বাংলাদেশি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে হাইকমিশন তদন্ত করে সত্যতা বের করুক। আমরা মেয়েটির সঙ্গে আছি। যেকোনো সহযোগিতা প্রয়োজন হলে আমরা সেটা করব।

এ বিষয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ভুক্তভোগী এই নারী যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেটি ভয়াবহ। বিদেশে কাজের কথা বলে কাউকে যৌন নিপীড়ন করা বা পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করানো মানবপাচারের মধ্যে পড়ে। মরিশাস এবং বাংলাদেশ সরকারের উচিত যৌথভাবে এই ঘটনার তদন্ত করা। আরও কোনো বাংলাদেশি নারী এমন নিপীড়নের শিকার কি না সেটিও খুঁজে বের করে বিচার করা উচিত। আশা করছি মন্ত্রণালয় ও দূতাবাস এ ব্যাপারে উদ্যোগী হবে।

রামপুরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সাইফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, আকতার হোসেন নামে একজনকে আটক করা হয়েছে। এটা মূলত মানবপাচার। আমরা বাকীদের বিষয়েও কাজ করছি। রামপুরা থানার মামলা নম্বর ১০(৭)২১ ধারা: মানবপাচার ৭/৮/৯। নারী ও শিশু নির্যাতন ৯(১) / ৩০ দণ্ডবিধি ৩১৩।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী নারীটিকে আইনি সহায়তা দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাসমিয়া নুহিয়া আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন নারী স্বাবলম্বী হতে বিদেশ যাচ্ছেন। তারা যখন যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তখন প্রায়ই কথা বলেন না বা প্রকাশ করেন না। যারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তাদের আইনের সহায়তা নিতে হবে। আমরা নারীটির পাশে আছি। আমরা চাই না কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হোক। নারীর সম্মান কখনো হারায় না। এ ধরনের ঘটনায় নারীর সম্মান যায় না। নারীর সম্মান নিয়ে যারা খেলা করে তাদের আমরা আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে চাই।

ভুক্তভোগীর অভিযোগের বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সারাবাংলা/এসজে/আইই

টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর