Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হাইতির প্রেসিডেন্ট হত্যাকাণ্ড: ঘটনার বর্ণনা দিলেন স্ত্রী

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১১ জুলাই ২০২১ ০৪:৩৫

রাতের আঁধারে একদল ঘাতকের হামলায় খুন হওয়া হাইতির প্রেসিডেন্টের চিকিৎসাধীন স্ত্রী ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। শনিবার (১০ জুলাই) দেশটির ফার্স্ট লেডি মার্টিনা মোসে জানান, ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটেছে যে, প্রেসিডেন্ট জোভেন মোসে একটি শব্দ উচ্চারণেরও সময় পাননি।

যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামির একটি হাসপাতাল থেকে টুইটারে এক ভয়েসবার্তায় মার্টিনা মোসে জানান, ৭ জুলাই মধ্যরাতে ঘাতকদল পোর্ট অব প্রিন্সে প্রেসিডেন্টের বাড়িতে ঢুকে। তারা এক মুহূর্তের মধ্যেই প্রেসিডেন্টকে হত্যা করে।

বিজ্ঞাপন

অস্ত্রধারীদের হামলায় ফার্স্ট লেডি মার্টিনা মোসে নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামির একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি। ঘটনার পর দুই দিন তার অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। বর্তমানে অনেকটাই শঙ্কামুক্ত তিনি।

শনিবার মার্টিনা মোসে তার টুইটারে ভয়েসবার্তায় বলেন, “চোখের পলকে ভাড়াটে খুনিরা আমার বাড়িতে ঢুকল এবং আমার স্বামীকে গুলি করল”। তিনি বলেন, “এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের কোনো নাম নেই। কারণ জোভেন মোসের মতো প্রেসিডেন্টকে একটি শব্দ উচ্চারণ করার সুযোগ না দিয়ে খুন করার জন্য আপনাকে সীমাহীন অপরাধী হতে হবে”।

মার্টিনা মোসে বলেন, “নামহীন ঘাতকরা প্রেসিডেন্টের স্বপ্নকে হত্যা করতে চেয়েছে। আমি কাঁদছি, এটা সত্য। কিন্তু আমাদের দেশকে তার পথ থেকে বিচ্যুত হতে আমরা দেব না। আমরা প্রেসিডেন্টের রক্তকে বৃথা যেতে দেব না। আমরা প্রেসিডেন্টকে ভালোবাসি, তিনিও আমাদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন”।

তদন্তকারীর ভাষ্যে ঘটনাস্থলের বিবরণ

তবে বুধবার রাতে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঠিক কীভাবে হামলা হয়েছে তার বিস্তারিত এখনও জানা যায়নি। এছাড়া এ ঘটনার উদ্দেশ্য বা মোটিভ সম্পর্কেও অন্ধকারে গোয়েন্দারা। হাইতির স্থানীয় ডিসট্রিক্ট কোর্টের বিচারপতি কার্ল হেনরি ডেস্টিন এ ঘটনার তদন্ত করছেন। তিনি মার্কিন সংবাধমাধ্যম  সিএনএনকে ঘটনাস্থলের অবস্থা সম্পর্কে জানিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

কার্ল হেনরি ডেস্টিন বলেন, “দরজাগুলো গুলিবিদ্ধ এবং ভাঙা পাওয়া গেছে। বাড়ির সব কাচ ভেঙে গেছে। দরজার তালাগুলোও ভেঙে ফেলা হয়েছে। এগুলো নিচে পাওয়া গেছে”।

তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্টের ঘরে তার মরদেহ পাওয়া যায়, তার পরনে ছিল সাদা শার্ট ও নীল জিনস। তার শার্ট ছেড়া ও রক্তভেজা পাওয়া গেছে। প্রেসিডেন্টের শরীরে আমি ১২টি বুলেটের চিহ্ন দেখেছি। খুনিরা তার বাম চোখে গুলি করলেও মরদেহ উদ্ধারের সময় চোখ দুটোই খোলা ছিল”।

হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য 

এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা হয়েছে বলে দাবি করছে হাইতির পুলিশ বিভাগ। ইতিমধ্যে ঘাতকদলের প্রত্যেকের পরিচয় পাওয়া গেছে বলেও জানানো হয়েছে। তবে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিকল্পনায় এবং কী উদ্দেশ্য প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হলো তা এখনও জানা যায়নি।

অবশ্য ফার্স্ট লেডি মার্টিনা মোসে ওই ভয়েস বার্তায় জানান, তার স্বামীকে রাজনৈতিক কারণে হত্যা করা হয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে তিনি জানান, সম্প্রতি হাইতিতে একটি গণভোটের আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রেসিডেন্ট। এ গণভোটে জয় পেলে প্রেসিডেন্ট পদের ক্ষমতা আরও বেড়ে যেত। এ কারণেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন বলে দাবি ফার্স্ট লেডি মার্টিনা মোসের।

মূলত হাইতিতে গত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। জোভেন মোসে ২০১৭ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। গত বছর ও চলতি বছরের বিভিন্ন সময়ে রাজধানীসহ বহু এলাকায় তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন হয়।

২০১৯ সালের অক্টোবরে হাইতিতে পার্লামেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। তবে এক স্থগিতাদেশের কারণে নির্বাচন এখনও অনুষ্ঠিত হয়নি। অর্থাৎ, প্রেসিডেন্ট মোসে অধ্যাদেশের মাধ্যমে দেশ শাসন করছিলেন। আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ হাইতির সংবিধানে সংশোধন প্রস্তাবের উপর একটি গণভোটের পরিকল্পনা করছিলেন তিনি। এ গণভোটে জয় পেলে সংবিধান সংশোধনের ফলে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা আরও বেড়ে যেত।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিরোধী দল প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবি তুলেছিল। প্রেসিডেন্ট জোভেন মোসে সে সময় বলেছিলেন, তাকে হত্যা করে সরকার উৎখাতের একটি পরিকল্পনা তিনি ব্যর্থ করে দিয়েছেন।

গত বুধবার রাতে হাইতির রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্সে বাড়িতে একদল ঘাতকের হামলায় প্রাণ হারান প্রেসিডেন্ট জোভেন মোসে। এ ঘটনায় তার স্ত্রী মার্টিনা মোসেও গুরুতর আহত হন।

কলম্বিয়ানরা ঘাতক, নাকি দেহরক্ষী

শুক্রবার হাইতির পুলিশ প্রধান লিওন চার্লস এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনার কিছু তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি জানান, হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভেন মোসেকে খুন করেছে একটি বিদেশি ঘাতকদল। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ার সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কিছু সেনা এ ঘাতকদলের সদস্য। এছাড়া এ দলে দুজন হাইতিয়ান-আমেরিকানও ছিল। তবে ঘটনার ‘মাস্টারমাইন্ডদের’ পরিচয় এখনও জানা যায়নি।

পুলিশ প্রধান জানান, ঘাতকদলে মোট ২৬ কলম্বিয়ান অবসরপ্রাপ্ত সেনা ছিল। আরও ছিল দুজন হাইতিয়ান-আমেরিকান। ওই দুই আমেরিকানসহ ১৭ জনকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। আট ঘাতক এখনও পলাতক। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। এর বাইরে অন্য সন্দেহভাজন কয়েকজনকে বৃহস্পতিবার রাজধানী পোর্ট-অব-প্রিন্সে শুটআউটে হত্যা করেছে পুলিশ।

কলম্বিয়া সরকার জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট জোভেন মোসের হত্যাকারীদের ধরতে হাইতিকে সর্বোচ্চ সহায়তা করা হচ্ছে। ওই ঘাতকদলের কমপক্ষে ছয়জন সদস্য দেশটির অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্য নিশ্চিত করেছে কলম্বিয়া। কলম্বিয়ার একটি তদন্ত দল শুক্রবার হাইতির রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্সে পৌঁছেছে।

তবে পুলিশের এমন দাবিকে অসত্য বলে নাকচ করে দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক সিনেটর স্টিভেন বেনইট। স্থানীয় রেডিও স্টেশন ম্যাগিক৯’কে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কলম্বিয়ানরা নয়, প্রেসিডেন্টকে তার নিজস্ব দেহরক্ষীরাই হত্যা করেছে।

কলম্বিয়ার ম্যাগাজিন সেমানায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কলম্বিয়া থেকে ওই অবসরপ্রাপ্ত সেনারা জোভেন মোসেকে হত্যা করতে যায়নি। তিনি হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন বলেই এসব সেনাদের তার দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তারা কলম্বিয়া থেকে হাইতিতে গিয়েছিল তাকে রক্ষা করতে।

কলম্বিয়ার সংবাদমাধ্যম এল টিয়েম্পোর অন্য এক খবরে জল্পনা আরও ডালপালা মেলেছে। ওই প্রতিবেদনেও হাইতির এক সূত্রের বরাতে বলা হয়, নিরাপত্তা ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, কলম্বিয়ানরা বুধবার রাত ২:৩০ থেকে ২:৪০ এর মধ্যে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছে। এর অর্থ হলো, তারা ঘটনার দেড় ঘণ্টা পরে সেখানে গিয়েছিল। উল্লেখ্য, বুধবার রাত ১টায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ইতিমধ্যে জানিয়েছে হাইতির পুলিশ।

হাইতি পুলিশের সঙ্গে বন্ধুযুদ্ধে নিহত সন্দেহভাজন কলম্বিয়ান ডুবেরনে কাপারের বোন জেনি ক্যারোলিনা বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেন, অবসরপ্রাপ্ত সেনারা হাইতিতে হাই প্রফাইল ব্যক্তিদের নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজের প্রস্তাব পেয়েছিল।

তিনি বলেন, “আমার ভাই ওই ঘটনার পর আমাকে একটি বার্তা পাঠায়, সে বলে, ‘আমরা সেখানে দেরীতে পৌঁছেছি। দুর্ভাগ্যবশত যাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের ছিল আমরা তার জন্য কিছু করতে পারিনি”।

প্রেসিডেন্টের হত্যাকাণ্ডের পর হাইতির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কার্যত ভেঙে পড়েছে। দেশটির শহর থেকে গ্রামে প্রতিবাদ মিছিল, বিক্ষোভ ও নানা কর্মসূচি সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। দেশটিতে একাধিক দাঙ্গার ঘটনা ঘটছে।

বিদেশ থেকে একদল ঘাতক এসে কেনই বা প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেছে তা এখনও পরিষ্কার নয়। এ ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

– বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স ও দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত বিভিন্ন খবর অবলম্বনে

সারাবাংলা/আইই

টপ নিউজ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর