মুজিববর্ষে উপহারের ঘর নির্মাণে দুর্নীতি, ক্ষুব্ধ রাজনীতিকরা
১১ জুলাই ২০২১ ২৩:২৭
ঢাকা: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী বা মুজিববর্ষ উপলক্ষে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম দেশের ভূমিহীন-গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ। এরই মধ্যে এক লাখেরও বেশি ঘর ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে হস্তান্তর করা হয়েছে। আরও প্রায় সাড়ে সাত লাখ ঘর নির্মাণ করা হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির খবরে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বছর না ঘুরতেই হস্তান্তর করা ঘরগুলোর মধ্যে কিছু ভেঙে গিয়েছে, কোনো কোনো ঘরে দেখা দিয়েছে বিশাল ফাটল, আবার কোথাও ঘরের মাটি দেবে গেছে। অভিযোগ উঠেছে, সঠিক স্থান নির্বাচন না করা এবং নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের ফলেই এমনটি হয়েছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পে জড়িত মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সরকার। এরই মধ্যে মাঠ প্রশাসনের পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কাজ করছে তদন্ত কমিটি। এতে আরও অনেক কর্মকর্তা শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন। এসব ঘটনা নিয়ে সমালোচনা চলছে প্রশাসনে, এমনকি রাজনীতিতেও। দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান আওয়ামী লীগ নেতারা, রাষ্ট্রযন্ত্রের সিস্টেমে পরিবর্তনের পরামর্শ জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের। আর জবাবদিহিতার অভাব থাকায় এমন ঘটনা বলে মন্তব্য করছেন কেউ কেউ।
কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না— জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিশেষ এই উদ্যেগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অগ্রাধিকারমূলক এই প্রকল্পের আওতায় দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা পৌনে নয় লাখ পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যার মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার ঘর হস্তান্তরও করা হয়েছে। আর এসব ঘর নির্মাণের শুরুতেই অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাসিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘একজন সহায় সম্বলহীন মানুষকে আশ্রয় দিতে জননেত্রী শেখ হাসিনা একটি মহান উদ্যোগ নিয়েছেন। একটা স্বপ্ন পূরণের উদ্যোগ। এই মহতি উদ্যোগকে বিতর্কিত করা, প্রশ্ন বিদ্ধ করা এবং সহায়-সম্বলহীন মানুষদের জন্য নেওয়া কর্মসূচিতে দুর্নীতি করার সাহস কি করে পেল? এটা খুব নিন্দনীয় এবং হতাশাজনক। এত বড় ধৃষ্টতা যারা দেখিয়েছেন তিনি রাজনৈতিক নেতা কিংবা সরকারি কর্মকর্তা যে-ই হোন না কেন, তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরণের দুঃসাহস দেখাতে পারবে না।’
এদিকে সর্বত্র জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের। জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় এই উপনেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমলাদের সহযোগিতা ছাড়া কোনো রাজনীতিক দুর্নীতি করতে পারে না। কারণ মূল কাজ আমলারাই করেন। প্রশাসনের কর্তারা সৎ হলে রাজনীতিকদের অসৎ হওয়া মুশকিল। এ ঘটনা দুঃখজনক। যখন বলা হতো রাজনীতিকরা সবচেয়ে বেশী দুর্নীতিবাজ, তখনও প্রশাসনের কর্তারাই পেছনে থেকে দুর্নীতি করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি বন্ধ করতে সবখানে জবাবদিহিতা নিশ্চিতের স্তর থাকা দরকার ছিল। এটা সিস্টেমে আছে, কিন্তু বাস্তবায়নে নেই। কি করছে, কেন করছে- কোনো অনিয়ম ধরা পড়লে চেইন অব কমান্ড নেই। এগুলোতে জবাবদিহিতা আনতে হবে।’
এদিকে এসব ঘটনা তদন্তে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আলাদা পাঁচটি তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। সেসব দল এখন সরেজমিন পরিদর্শনে রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি স্থানে অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। আবার কোথাও কোথাও আংশিক সত্যতা মিলেছে। মুন্সীগঞ্জে পরিদর্শনে যাওয়া একটি টিমে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার। সারবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জের ভাষানচরে একসঙ্গে দুইশ ঘর রয়েছে। যেগুলোর নির্মাণ কাজ এখনও শেষ হয়নি। আমরা মূলত অভিযোগের ভিত্তিতেই এই এলাকা পরিদর্শনে এসেছি। অভিযোগ করা হয়েছিল, নিম্নমানের উকরণ দিয়ে এখানে ঘর নির্মাণ চলছে। কিন্তু আমরা এখানে এসে অভিযোগের সত্যতা পাইনি। এখানে দেখা গেছে, পাইলিংয়ের কিছু বালু ধুয়ে গেছে। কিছু ঘরের সামনের মাটি সরে গেছে। এতটুকু হয়েছে বৃষ্টির কারণে।’
আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় ঘর নির্মাণের অনিয়ম তদন্তে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গঠিত পাঁচটি দল প্রকল্প বাস্তবায়ন এলাকা পরির্দশনে রয়েছে। তদন্ত করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও। এরই মধ্যে ৩৬ জন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তার অনিয়মের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, এ ঘটনায় শতাধিক কর্মকর্তা ফেঁসে যেতে পারেন।
এদিকে দেশের ২২ জেলার উপজেলাগুলোতে ঘর নির্মাণে নানাধরনের অনিয়ম কমিটির সামনে এসেছে। যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে- খাস জমিতে নির্মাণ করা ঘরগুলো নির্মাণের আগে যথাযথভাবে ভরাট না করা, স্থান নির্বাচনে অপ্রতুলতা, নিম্নমানের উপকরণ দেওয়া ইত্যাদি। অনিয়মে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদেরও নামও শোনা যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৩৬টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের জড়িত থাকার কথা শোনা যাচ্ছে।
এর আগে গত ৪ ও ৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার মূলক এই প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে মাঠ প্রশাসনের পাঁচ কর্মকর্তাকে ওএসডি করে আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এদের একজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে, বাকি চারজনের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারের থাকা কোনো কাজে দুর্নীতির নিন্দা জানিয়ে সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘শুধু আওয়ামী লীগ সরকারই নয়, বিএনপি সরকারের সময়ও নীতি ছিল- চুরি করে হলেও টাকা বানাবে। আর সে টাকা চলে যায় কানাডা, সুইজারল্যান্ড। আমাদের দেশে চরম পুঁজিবাদের কারণে আমলাদের আজকের এই পরিণতি।’
গত দুই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘সরকারের কারণেই প্রশাসনের কর্মকর্তারা আজ এই দুঃসাহস দেখাতে পারছে। সংসদে নেতারা এ নিয়ে কথা বলছেন। আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে না। যা নেওয়া হচ্ছে তা লোক দেখানো। এই ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য দরকার বিপ্লব।’
জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার সারাবাংলাকে বলেন, ‘যতক্ষন পর্যন্ত আইনের শাসন বাস্তবায়ন না হবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততদিন এমন ঘটনা ঘটতে থাকবে। না হলে এর থেকে উত্তরন ঘটানো সম্ভব না। সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর হওয়া দরকার।’
উল্লেখ্য, জমিও নেই, ঘরও নেই কিংবা ঘর আছে তাতে মাথা গোঁজার অবস্থা নেই। দেশের এমন মানুষদের ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে সরকার।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম