সিআরবিতে হাসপাতাল নয়— ১৭ বিশিষ্টজনের বিবৃতি
১২ জুলাই ২০২১ ১৯:০৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম শহরের ফুসফুসখ্যাত সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের খবরে উদ্বেগ ও ক্ষোভ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ১৭ বিশিষ্ট নাগরিক। অবিলম্বে এই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেছেন, অন্যথায় বৃহত্তর আন্দোলন ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সোমবার (১২ জুলাই) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিশিষ্টজনেরা সিআরবি থেকে সরিয়ে চট্টগ্রামের অন্য কোথাও হাসপাতাল নির্মাণের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন।
বিবৃতিদাতারা হলেন- শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফী, প্রফেসর ড. অনুপম সেন, প্রফেসর ড. সিকান্দার খান, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, প্রফেসর আবুল মনসুর, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, প্রফেসর ডা. এ. কিউএম সিরাজুল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস, অধ্যাপক ফেরদৌস আরা আলীম, ডা. চন্দন দাশ, নাট্যব্যক্তিত্ব আহমেদ ইকবাল হায়দার, প্রফেসর অলক রায়, স্থপতি জেরিনা হোসেন, প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার এবং আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান।
গণমাধ্যমের খবরে সিআরবি-সাতরাস্তার মোড়ে বহুতল হাসপাতাল নির্মাণে বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে রেলওয়ের চুক্তির বিষয়টি জানতে পারার কথা উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, খবরটি চট্টগ্রামের আপামর মানুষকে অত্যন্ত ব্যথিত, উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ করেছে। হাসপাতালে স্বভাবতই অসুস্থ মানুষদের সমাগম ঘটবে, যা এলাকার পরিবেশকে প্রভাবিত করবে এবং এতে জনসাধারণের স্বাস্থ্য, সকাল ও বিকালের ভ্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। প্রবীণ নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার অধিকার ক্ষুণ্ন হবে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমাদের দেশে একজন রোগীকে ঘিরে হাসপাতালে বহু মানুষের আগমন ঘটে। এতে সিআরবির মতো একটি নির্জন এলাকার স্বাভাবিক পরিবেশ ক্ষুণ্ন হবে। দেশে হাসপাতালের বর্জ্য নিষ্কাশন ও ব্যবস্থাপনার উপযুক্ত দক্ষতার অভাব রয়েছে। এখানেও তার পুনরাবৃত্তিরই আশঙ্কা রয়েছে। কেননা শত প্রতিশ্রুতি ও আইনি ব্যবস্থার পরও এমন নজিরই দেখা যায়। এতে পুরো এলাকা ও আশেপাশের অন্তত অর্ধশত খাদ্যবিপণি প্রতিষ্ঠান মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।
প্রাসঙ্গিক আরও কয়েকটি বিষয় তুলে ধরে বিশিষ্টজনেরা বলেন, সিআরবি, সাত রাস্তার মোড় ও টাইগার পাস এলাকা ঘিরে থাকা পাহাড় ও উপত্যকায় গাছপালামণ্ডিত যে এলাকা রয়েছে, সেটা চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসেবেই গণ্য হয়। সমুদ্রবর্তী, নদীবেষ্টিত এই পাহাড়ি শহরটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে যুগ যুগ ধরে দেশি-বিদেশি পর্যটক, ঐতিহাসিক, রাজনীতিক ও আগন্তুকদের মনোযোগ ও প্রশংসা কুড়িয়ে আসছে। এই আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র সিআরবিও বটে। কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই নয়, এটি ঐতিহাসিক কারণেও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল।’
ওই এলাকায় ১৯৩০ সালের ইতিহাস-প্রসিদ্ধ চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহীরা অর্থ সংগ্রহের জন্যে অভিযান চালিয়েছিল। সিআরবি ভবনটি দেশের ব্রিটিশ বা কলোনিয়াল স্থাপত্যের বিলীয়মান নিদর্শনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি। এটি স্থাপত্যকলা ও ইতিহাসের ছাত্র-শিক্ষকের শিক্ষা ও গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এসব বিবেচনা থেকেই এলাকাটিকে বাংলাদেশ সরকার সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ২৪ ধারা অনুযায়ী ঐতিহ্য ভবন ঘোষণা করে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছে।
বিশিষ্টজনেরা আরও বলেন, আমরা হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধী নই, কেবল একটি প্রাকৃতিক কারণে সংবেদনশীল ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের স্থানে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ অনুচিত বলে মনে করছি। চট্টগ্রামে আধুনিক হাসপাতালের প্রয়োজন আছে, তবে তা উপযুক্ত স্থানেই নির্মিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই নির্জন মনোরম এলাকাটি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষদের বাৎসরিক কয়েকটি উৎসব পালনের ভেন্যু হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মনে রাখতে হবে, অবকাঠামোগতভাবে দ্রুত বর্ধিষ্ণু এই নগরে রাজধানী ঢাকার মত রমনা পার্ক নেই, নেই সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মত সবুজ-ঘেরা কোনো বড় অঞ্চল। নগরের মধ্যে অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র এই একটি এলাকা।
সবদিক বিবেচনা করে এই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, অন্যথায় নাগরিক সমাজ আরও বৃহত্তর আন্দোলন ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হবে।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম