জনবল ঘাটতিসহ নানামুখী সমস্যায় আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার প্রকল্প
১৩ জুলাই ২০২১ ১০:০১
ঢাকা: প্রভাবশালীদের চাপে পড়ে ফ্রি চিকিৎসা ও সিজার করা হয় ‘আরবান হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি’ প্রকল্পে। এক্ষেত্রে লাল কার্ড না থাকার পরও তাদের সেবা দিতে বাধ্য হন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে জনবলের ঘাটতি, পর্যাপ্ত বেতন-ভাতার অভাব, চাকরির স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কা, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত এনজিওদের জনবলের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব এবং চুক্তির বাইরে কাজসহ রয়েছে নানা দুর্বল দিক। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরীক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
তবে সার্বিকভাবে প্রকল্পটি দরিদ্র মা ও শিশুদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বৃদ্ধি এবং এই সেবার কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বিনামূল্যে দরিদ্রদের দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রদত্ত সেবার মান উন্নয়ন এবং নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ ও কার্যকর সেবা দেওয়ায় নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আর্থিক ও প্রতিষ্ঠানিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সহায়তা করছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদন প্রসঙ্গে আইএমইডি’র সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবেদনটি কেবল চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমরা নিজেদের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পরিবীক্ষণ করিনি। প্রকল্পের দূর্বল দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করব। তৃতীয় পক্ষ নিয়োগের মাধ্যমে এটি করা হয়েছে। যাতে নিরপেক্ষভাবেই প্রতিবেদন তৈরি করা সম্ভব হয়।’
আইএমইডি’র পরীক্ষণ প্রতিবেদন
আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, শহরাঞ্চলের বিত্তবান জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ থাকলেও দরিদ্র, বিত্তহীন জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। তাদের এই চাহিদা পূরণ করতে এক হাজার ১৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া হয় ‘আরবান হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্ট’ (দ্বিতীয় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পটি। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ২৪০ কোটি এবং এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ৮৯৬ কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের ৩১ মার্চে বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়- প্রাপ্ত সেবায় সন্তুষ্টি প্রকাশ সম্পর্কে উপকারভোগীরা জানান, তারা নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নগর মাতৃসদন থেকে প্রাপ্ত সেবায় মোটামুটি সন্তুষ্ট ৫৬ শতাংশ, খুবই সন্তুষ্ট ৩৬ শতাংশ এবং ৮ শতাংশ সন্তুষ্ট নয় বলে জানায়। প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য সবল দিক গুলো হলো- হতদরিদ্র ও দুস্থ ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে বিনামুল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান, সুন্দরভাবে ইপিআই (টিকা দান) কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সরকারি নির্দেশনা মতে কোভিড-১৯ করোনা ভ্যাকসিন প্রদান, স্বাস্থ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ (বিশেষ করে কিশোরী মেয়ে ও গর্ভবতী মা) প্রদান, রোগীকে কাউন্সিলিং, পরামর্শ, উপদেশ প্রদানে গোপনীয়তা রক্ষা, জটিল রোগীকে উপযুক্ত স্থানে রেফার করা, নারী নির্যাতন প্রশমনে সেবা দেওয়া এবং প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা দেওয়া।
প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- গর্ভবতী মায়েদের জরুরি সিজারের সময় দক্ষ অ্যানাস্থেসিওলজিস্টের অভাব রয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে সেবা প্রদানকারীদের চাকরির স্থায়ীত্ব নিয়ে শঙ্কা। এছাড়া প্রত্যেক কেন্দ্রে মাত্র একজন করে নিরাপত্তা প্রহরী রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এদিকে প্রত্যেক কেন্দ্রে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য একজন করে ড্রাইভার রয়েছে। ফলে অনেক সময় জরুরি সেবা দিতে বেগ পেতে হয়।
২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের মোট ব্যয় ২১ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি ৩৪ শতাংশ। প্রকল্প অফিস ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগাযোগ করা হলে তারা সারাবাংলাকে জানান, প্রকল্প অফিস যথাসময়ে অর্থ ব্যয়ে ব্যর্থ হলেও টাকা আনডিসবাস্টমেন্ট থাকার জন্য সরকারের পক্ষ হতে কোন প্রকার ফি দিতে হয়নি। প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত তিনটি অর্থবছরের অডিট সম্পন্ন হয়েছে এবং মোট ১৪টি আপত্তি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। তবে বাকি ১৬ টি আপত্তির জবাব দেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলমান নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা পরিচালনার জন্য প্রকল্পভুক্ত এলাকা থেকে পরিমাণগত ও গুণগত উভয় পদ্ধতিতে তথ্য-উপাত্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উৎস হতে সংগ্রহ করা হয়েছে। নিবিড় সাক্ষাৎকারের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা, ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক, সহযোগী এনজিও বিভিন্ন কমিটির সদস্য ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মোট ৭২ জনের নিবিড় সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও পরিমাণগত সমীক্ষার জন্য এক হাজার ২৮০ জন উপকারভোগীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ, আটটি দলীয় আলোচনা অনুষ্ঠান এবং স্থানীয় পর্যায়ে একটি অর্ধ-দিবস কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে।
শহরের দরিদ্র হতদরিদ্র ছিন্নমূল মানুষ নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরাই প্রকল্প থেকে সেবা নিয়ে থাকেন। তবে জটিল রোগীদেরকে যেমন, জরায়ু ও স্তন ক্যান্সারের রোগীদের নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও নগর মাতৃসদনে ভায়া টেস্ট ও স্ক্যাকানিংয়ের মাধ্যমে বাছাই করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিসহ সব বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজে রেফার করা হয়ে থাকে।
আইএমইডি’র সুপারিশ
প্রকল্পের কাজ আরও সুন্দর ও সাবলীল করার জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সম্পূর্ণ ফ্রি রেড কার্ডের সুবিধার পাশাপাশি হলুদ কার্ডের ব্যবস্থা করা। যাতে দরিদ্র মায়েরা অর্ধেক মূল্যে সেবা নিতে পারেন। এছাড়া প্রকল্পের অগ্রগতিতে মূল বাধা সময়মত পণ্য, কাজ ও সেবা সংগ্রহে ব্যর্থতা; যা প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত। প্রকল্প কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেওয়া ও উদ্ভুত সমস্যা নিরসনের ব্যবস্থা গ্রহণে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নিয়মিতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) ও প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভা আয়োজন করা প্রয়োজন।
এছাড়াও পিআইসি কমিটির সদস্যদের সরেজমিনে প্রকল্পের কার্যক্রম পরিদর্শন, প্রয়োজনীয়, দিকনির্দেশনা প্রদান প্রকল্পের গতিকে ত্বরান্বিত করবে। এর পাশাপাশি নগর মাতৃ সদনে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ও সোনোলজিস্ট নিয়োগ, সহযোগী জনবল বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও মাতৃ সদনে পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ, ল্যাবের টেস্ট উন্নতি এবং নিযমিত পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য পৃথক কক্ষ এবং নগর মাতৃসদনে অ্যাম্বুলেন্স, ব্লাড ব্যাংক ও অক্সিজেন সরবরাহ আবশ্যক। জরুরি সেবার জন্য ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিসের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া তৃপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় সভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দ্রুত অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে।
সারাবাংলা/জেজে/পিটিএম