টিভ্যাসে বিদেশি বিনিয়োগের আগ্রহে দেশীয় উদ্যোক্তাদের শঙ্কা
১৩ জুলাই ২০২১ ২৩:২৮
ঢাকা: দেশে টেলিকম ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসেস (টিভ্যাস) খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে আগ্রহী বিদেশি কোম্পানিগুলো। বর্তমানে কোনো একটি কোম্পানিতে ৭০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমোদন থাকলেও একটি কোম্পানি ৯০ শতাংশ পযর্ন্ত বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছি। আবার লন্ডনভিত্তিক একটি কোম্পানি এ খাতে শতভাগ বিনিয়োগ করতে চায়। টিভ্যাস খাতে বিদেশি বিনিয়োগের এই আগ্রহকে শঙ্কা হিসাবে দেখছেন এই খাতের দেশীয় উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, এখন যে নিয়ম আছে সেই নিয়মই বহাল রাখতে হবে। অর্থাৎ একটি কোম্পানিতে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগ থাকতে পারে, বাকি ৩০ শতাংশ দেশীয় উদ্যোক্তাদের হাতেই থাকতে হবে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে ১৮৩ টি টিভ্যাস প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গাইডলাইন অনুযায়ী এসব কোম্পানিতে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে সম্প্রতি বিদেশি বিনিয়োগের শতকরা পরিমাণ বাড়ানোর জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিতে একটি টিভ্যাস প্রতিষ্ঠানের আবেদন করেছে।
জানা গেছে, স্টেলার ডিজিটাল লিমিটেড নামের ওই টিভ্যাস প্রতিষ্ঠান তাদের বৈদেশিক মালিকানা ৭০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশে উন্নীত করে দেশি মালিকানা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার অনুমোদন চেয়ে বিটিআরসিতে আবেদন করে। কমিশনের ২৫১তম বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তর আলোচনাও হয়েছে।
এ খবরেই টিভ্যাস খাতের দেশীয় উদ্যোক্তারা শঙ্কার কথা জানাচ্ছেন। তাদের শঙ্কার মূলে রয়েছে বিদেশি কোম্পানির বড় অঙ্কের বিনিয়োগের কাছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের স্বল্প পুঁজির অসম প্রতিযোগিতা তৈরির বিষয়টি। এমনটি হলে দেশীয় কোম্পানিগুলোর অস্তিত্ব নিয়েই সংকট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
শঙ্কা জানিয়ে টিভ্যাস অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক রাফিউর রহমান ইউসুফজাই সারাবাংলাকে বলেন, বর্তমান নীতিমালার বাইরে গিয়ে বিদেশি কোম্পানিগুলো খাতটিতে বিনিয়োগ করলে অবশ্যই দেশীয় টিভ্যাস খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশিরা এখন একটি কোম্পানিতে ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারে। আমরা চাই এভাবেই পর্যাপ্ত পরিমাণ বিনিয়োগ আসুক। তারা কোনো কোম্পানিতে ৯০ শতাংশ বিনিয়োগ করলে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে।
তিনি বলেন, বিদেশি বেশ কিছু কোম্পানি আগেও এসেছে, আবার চলে গেছে। কারণ তারা আমাদের দেশের উপযোগী কনটেন্ট তৈরি করতে পারে না। আমরা চাই তারা বর্তমান নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিনিয়োগ করুক। আমি মনে করি আমাদের বর্তমান যে নীতিমালা রয়েছে, তাদের দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীর জন্যই সুযোগ রয়েছে। নীতিমালা পরিবর্তন করে বিদেশিদের শেয়ার বাড়ানো হলে দেশীয় উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার অবশ্য মনে করছেন, বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। মন্ত্রী সারাবাংলাকে বলেন, যারা বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে কথা বলছে তারা না জেনে কথা বলছে। জাতীয় বিনিয়োগ নীতিমালাতেই বলা আছে, কোনো বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে শতভাগ বিনিয়োগ করতে পারবে। ই-কমার্সে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা একটি সীমা রেখেছিলাম। সম্প্রতি তা পরিবর্তন হয়েছে। একইভাবে টিভ্যাসে বিনিয়োগের নীতিমালাও পরিবর্তন করতে হবে। আমরা বিনিয়োগে কোনো প্রতিবন্ধকতা রাখতে চাই না। টিভ্যাস খাতে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়েও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর সারাবাংলাকে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাত এখন প্রবৃদ্ধি পর্যায়ে রয়েছে। খাতটির প্রবৃদ্ধির গতি ঊর্ধ্বমুখী। এই প্রবৃদ্ধি পর্যায়ে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে সুরক্ষা দিতে পারলে আমার মনে হয় ভালো হবে। যেহেতু শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগ আসতেও আপত্তি নেই, তাই শতাংশ হারে সুযোগ না দেওয়া গেলেও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইনসেনটিভ বা ট্যাক্স রিবেট দেওয়া হলে তা শিল্পের জন্যে ভালো।
জি-সিরিজের স্বত্বাধিকারী নাজমুল হক ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, খাতটিকে যত ক্যাপিটাল আসবে খাতটির তত উন্নয়ন ঘটবে। এমনিতেও এই খাতে বিনিয়োগ কম। বিদেশি বিনিয়োগ হলে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি হবে। তবে মাঝে মধ্যে অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান আসে, পরে আবার তারা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে চলে যায়। এ প্রবণতাটি ভালো নয়।
যে স্টেলার ডিজিটালের আবেদন নিয়ে এত হৈ চৈ, সেই স্টেলার ডিজিটাল লিমিটেডের পরিচালক নাভিদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, স্টেলার বিদেশি বিনিয়োগপ্রাপ্ত কোম্পানি। এখন শুধু শেয়ারহোল্ডিংয়ে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এই কোম্পানিতে বিদেশি বিনিয়োগ আগে থেকেই ছিল। আমরা আরও নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, টিভ্যাস খাতে এখন তেমন কাজ নেই। মার্কেট দিন দিন ছোট হচ্ছে। দুই বছর আগেও যেমন ছিল, এখন আর তেমন নেই। আর প্রযুক্তি তো আটকে রাখা সম্ভব নয়। বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি দেশে ব্যবসা
করছে। এখন বেশিরভাগ অ্যাপসই বিদেশি। তাই বিদেশি বিনিয়োগ আসতে পারে।
বিটিআরসি বলছে, জানে না কিছুই!
জানা গেছে, স্টেলার ডিজিটালের আবেদনটি নিয়ে বিটিআরসি’র ২৫১তম বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বিনিয়োগ বাড়াতে কোনো প্রতিষ্ঠান খ্যাতনামা কি না, তার মাপকাঠি নির্ধারণে পারফরম্যান্স যাচাই করা হবে। টেলিযোগাযোগ খাতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালনার অন্তত পাঁচ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এ ছাড়া বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগে আগ্রহী, সে সংক্রান্ত তথ্যও আমলে নেওয়া যেতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগে বিশেষ করে শুধু বিদেশি অংশ থেকে নগদ প্রবাহ কেমন হবে, পর্যালোচনা করা যেতে পারে সেটিও।
তবে বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদার সারাবাংলাকে বলছেন, টিভ্যাস খাতে কোনো বিদেশি উদ্যোক্তার বিনিয়োগ আসার খবর তার কাছে নেই। বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘টেলিকম খাতে যেকোনো বিদেশি কোম্পানি বিনিয়োগ করতে পারবে, সেটি টিভ্যাস হোক বা অন্য কোনো কোম্পানি হোক।’ আর বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র জানান, কোনো বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগের আবেদনের বিষয়টি তারও জানা নেই।
এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বড় বড় টিভ্যাস প্রতিষ্ঠান বসে আছে বিটিআরসি’র অনুমোদনের অপেক্ষায়। অনুমোদন পেলে দেশে নেটফ্লিক্স, হইচই, জি-ফাইভ, অ্যামাজন সরাসরি অফিস খুলে ব্যবসা শুরু করবে। বিনিয়োগ নীতিমালার কারণে তাদের এ দেশীয় কোনো উদ্যোক্তার প্রয়োজন হবে না। এমনটি হলে দেশীয় ছোট উদ্যোক্তারা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। বাজারে তাদের টিকে থাকা কষ্ট হবে।
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর