ছাদে সবজি চাষ তুলনামূলক সহজ এবং আনুসাঙ্গিক খরচও অনেক কম। মাটি বা প্লাস্টিকের টব, ফলের ঝুড়ি, ট্রে, পানি, পানীয় বা তেলের বোতল, সিমেন্টের ব্যাগ, চটের বস্তা, জিওব্যাগ, কন্টেইনার থেকে শুরু করে বাসার পরিত্যক্ত বা ফেলনা বালতি, বাথটাব ইত্যাদি যেকোন পাত্রেই ছোট বড় সব ধরনের শাক সবজিই চাষ করা সম্ভব।
প্রথমে সবজি গাছের আকার বিবেচনায় রেখে পাত্র নির্বাচন করতে হবে। অর্থাৎ লাউ, কুমড়া শিম, বরবটি, শসা, করলার মত বড় সবজি গাছের জন্য অবশ্যই ড্রাম বা বালতির মত বড় পাত্র নির্বাচন করতে হবে। আবার বেগুন, টমেটো, মরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলির মাঝারি আকারের সবজি গাছের আট থেকে ১০ ইঞ্চি ব্যাস ও গভীরতার পাত্র বা টব হলেই যথেষ্ট। তবে লালশাক, পালংশাক, পুঁইশাক, ডাটাশাকের মত সবজি চাষের জন্য টবের গভীরতা কম হলেও তা দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে যতটা বেশি হবে ফলনও ততো ভালো হবে। এসব শাক চাষের জন্য পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা অনুযায়ী পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি গভীরতার সিমেন্টের স্থায়ী বেড বা বাঁশ কাঠ, পলিথিন দিয়ে অস্থায়ী বেড কিংবা স্টিলের প্রশস্ত ট্রে বানিয়ে নেয়া যেতে পারে।
ছাদে সবজি চাষাবাদের জন্য যথাযথ পাত্র বাছাইয়ের পর তাতে সঠিক নিয়মে মাটি ভরাট করতে হবে। শাক সবজির শেকড় যেহেতু তুলনামূলক নরম ও ছোট তাই মাটি হতে হবে ঝুরঝুরে। এক্ষেত্রে বেলে দো-আঁশ মাটি ব্যবহার করাই সবচেয়ে ভালো। তাছাড়া চালনি দিয়ে চেলে নিতে পারলে মাটি সবজি চাষের জন্য আরো উপযোগী হয়ে ওঠে। পাত্র ভরাট করার আগে মাটির সাথে অবশ্যই পরিমাণ মতো জৈব সার মেশাতে হবে। পাত্রের আকার অনুযায়ী প্রতি পাত্রে দুই ভাগ মাটির সাথে এক ভাগ গোবর সার ভালভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। গোবর সার পাওয়া না গেলে পরিমান মতো জৈব কম্পোস্ট সার ব্যবহার করতে হবে। শাক সবজির জন্য সাধারণত কোন রাসায়নিক সার যেমন ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ইত্যাদি দেয়ার প্রয়োজন হয় না। রাসায়নিক সার দিলে শাক-সবজির স্বাদ কমে যায়। সেইসঙ্গে রোগ ও পোকার আক্রমণও বাড়ে। তবে বিশেষ প্রয়োজনে অল্প কিছু রাসায়নিক সারেরও দরকার হয়। যেহেতু ছাদে বা বারান্দায় রাখা পাত্রগুলোর মাটি ওলটপালট করা বা বার বার বদলানোর খুব একটা সুযোগ থাকে না, তাই প্রথমেই মাটির পরিমাণ কম দিয়ে জৈব সারের পরিমাণ বেশি করে দেয়া ভালো।
ছাদে শাক সবজি চাষের একটি প্রধান সমস্যা হলো পাত্রের মাটি শুকিয়ে যাওয়া। শাকসবজির গাছ মোটেই পানির অভাব সইতে পারে না। পানির ঘাটতি হলেই সেসব গাছ দ্রুত ঢলে পড়ে। তাই শাক সবজির পাত্রগুলো ছাদে পানির উৎসের কাছাকাছি রাখবেন যাতে ঘন ঘন পানি দেয়া সহজ হয়। আবার টবে যাতে অতিরিক্ত পানি না জমে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে এবং সকাল ও দুপুরের রোদ পায় এমন স্থানে টবগুলো রাখতে হবে। তবে গ্রীষ্মকালে দুপুরের রোদ বেশি প্রখর হলে ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। চারা ছোট থাকা অবস্থায় প্রথম এক সপ্তাহ হালকা সেড বা ছাউনির ব্যবস্থা করা গেলে তা চারাগাছের জন্য বেশ উপকারি। লতানো সবজি হলে গাছের জন্য বাউনির ব্যবস্থা করতে হবে। খুঁটি বা মাচার ব্যবস্থা অথবা রেলিং বা গ্রীলের সাথে বেঁধে দিলে অনেক সবজি গাছ সোজা থাকে ও ভাল বাড়ে।
বেডে শাকের বীজ ফেললে পাখির উপদ্রব বেড়ে যায়। ফলে বীজ ফেলার পর বেডটি প্রথম এক সপ্তাহ নেট বা মশারি দিয়ে ঢেকে রাখতে পারেন। গাছ বেড়ে ওঠার সাথে সাথে দফায় দফায় অল্প অল্প করে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে পাত্রে বেশী বেশী করে জৈব সার দেয়া যেতে পারে।
রোগ ও পোকা-মাকড় দমনে বালাইনাশক ছিটাতে ছোট হ্যান্ড স্প্রেয়ার সংগ্রহে রাখতে পারেন। তবে রাসায়নিক বালাইনাশকের বদলে তামাকের গুলের পানি, সাবানের পানি, নিম পাতার রস অথবা জৈব বালাইনাশকও স্প্রে করতে পারেন। পোকা দেখলে প্রথমে হাত দিয়ে মেরে ফেলবেন, রোগাক্রান্ত পাতা বা গাছ তুলে ধ্বংস করবেন। কুমড়া জাতীয় সবজি যেমন লাউ, মিষ্টি কুমড়া, কাকরোল, শসা, পটল ইত্যাদি সবজির ক্ষেত্রে হাত দিয়ে পরাগানের ব্যবস্থা করবেন। একই সময়ে ফোঁটা পুরুষ ফুল ছিঁড়ে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুন্ডের মাথায় ছোঁয়ালে ফল ভাল হয়। টবে গাছের সংখ্যা বেশি হলে পাতলা করে দেবেন। গাছের পাতা বা ডগার সংখ্যা বেশি হলে আথবা ফুল বা ফল বেশি হলে পাতলা করে দেয়া ভালো। খৈল পানিতে চার থেকে পাঁচদিন ভিজিয়ে রাখুন। এটি সাধারণ পানির সাথে এক চতুর্থাংশ হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় দিলে সবজির ফলন ভাল হয়। তবে এতে পিঁপড়ের উপদ্রব বাড়তে পারে। তাই সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে। এ ছাড়া কিছু ছাই ও হাঁড়ের গুঁড়োও মাটিতে মিশানো যেতে পারে, তাতে পটাশ ও ফসফেটের যোগান পওয়া যায়। ছাদের গাছের সবজি তোলার উপযোগী হলেই দেরি না করে তুলে ফেলা উত্তম। এক্ষেত্রে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, গ্রিন সেভার্স