সকলের কাছে অবহেলিত, মায়ের কাছে তারা স্বর্গ থেকে আসা সহোদর
১৬ জুলাই ২০২১ ০৮:৫১
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: দুই ভাই। একজনের বয়স ৩৫ বছর, এজনের ৪০ বছর। আর দশটি শিশুর মতোই মা-বাবার কোল আলো করে জন্ম হয় তাদের। কিন্তু বয়স বাড়তে থাকলে মা-বাবা বুঝতে পারেন, তারা আর সব শিশুর মতো নয়। শারীরিকভাবে তারা বড় হয়ে উঠছিলেন, কিন্তু মানসিকভাবে তারা শিশুই থেকে যাচ্ছিলেন। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশও হয়নি। গড় আয়ুর হিসাবে প্রায় অর্ধেকটা জীবন পেরিয়ে এলেও কোনো কাজ করা তো দূরের কথা, হাঁটাচলাটুকুও ঠিকমতো করতে পারেন না। বলতে পারেন না কথা, খেতে পারেন না নিজের হাতে। আর সে কারণেই সবার কাছে অবহেলা-উপহাসের পাত্র দুই ভাই মো. রহিম ও মো. অলি।
রহিম ও অলির বয়স বাড়তে থাকলে পরিবার যখন বুঝতে পারে তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে না, তখনই স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগাযোগ করেছিলেন মা মোছা. তাহমিনা বেগম (৬৫)। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, তার দুই সন্তানের ‘মগজ কম’। এ রোগের কোনো ওষুধ নেই। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই ভাই মূলত এনসেফালোপ্যাথি রোগে আক্রান্ত। এটি এমন একটি রোগ, যাতে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক কোনো কাজ করতে পারেন না, শুধু শারীরিকভাবে বেড়ে ওঠেন। মো. রহিম ও মো. অলি এই রোগে আক্রান্ত হলেও সবার কাছে উপহাসের পাত্র। কিন্তু মা তাহমিনা বেগম মনে করেন— তার দুই ছেলে স্বর্গ থেকে এসেছে।
বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে সমাজের চোখে ‘অস্বাভাবিক’ হয়ে ওঠা এই দুই সহোদরদের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর পৌরসভার বিশ্বাসপাড়া মহল্লায়। মৃত ফানসুর আলী ও তাহমিনা বেগম দম্পতির ঘরে জন্ম তাদের। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতের ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত দিনরাত ২৪ ঘণ্টা তাদের সবকিছুই করতে হয় মা তাহমিনা বেগমকে। এমনকি মা একটু চোখের আড়ালে গেলেই বাইরে চলে যায় রহিম-অলি। তাই কোনো কারণে বাড়ি থেকে বের হলে একজনকে ঘরের মধ্যে আটকে ও আরেকজনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখেন তাহমিনা। এভাবেই গত চার দশক ধরে শত দারিদ্র্যতা নিয়েও অসুস্থ দুই সন্তানকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন তিনি।
তাহমিনা বেগমের বড় সন্তান শাহাদাত হোসেন তোতা অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠেছেন। ছোট একটি মুদি দোকান চালান তিনি। মা, অসুস্থ দুই ভাই, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আট জনের পরিবারের তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মুদি দোকানের সামান্য আয় দিয়েও স্নায়বিক সমস্যায় আক্রান্ত অসুস্থ দুই ভাইকে আগলে রাখার জন্য মা’কে সর্বোচ্চ সহায়তা করে যাচ্ছেন তিনি।
স্বামী মারা যাওয়ার পর দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে অসুস্থ রহিম-অলিসহ তিন ছেলে ও এক মেয়েকে বড় করেছেন তাহমিনা বেগম। গত ৪০ বছর ধরে দুই ছেলেকে চোখে চোখে রেখেছেন তিনি। তিনি জানেন, তার চোখেই দুনিয়া দেখে দুই ছেলে, তার পা দিয়েই হেঁটে চলে রহিম-অলি।
তবে গত চার দশক ধরে এই দুই সন্তানের জন্য সকলের কাছে কষ্ট ও অবহেলা পেলেও নিজেকে ভাগ্যবান ও সুখী মনে করেন তাহমিনা বেগম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সবসময় একটা চিন্তায় থাকি, আমার তো বয়স হয়েছে। আমি না থাকলে তাদের কী হবে? কারণ তারা কারও কাছে থাকে না, কারও হাতে খায় না। দুই ভাইয়ের একজন তো মাকে ছাড়া ঘুমাতেই পারে না। তাদের চিন্তাই রাতে ঘুমও আসে না।’
তাহমিনা আরও বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই তাদের মাথার আকৃতি ছোট ছিল। এরপর স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা জানান— আমার ছেলেদের মাথায় মগজ কম। এর নাকি চিকিৎসাও নেই বলে জানান ডাক্তাররা।’
‘এরপর থেকে তাদের নিয়েই এভাবে চলে যাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে প্রস্রব-পায়খানা করানো, হাত-মুখ ধুয়ে দেওয়া দিয়ে দিনের শুরু হয়। এরপর মুখে খাবার তুলে দেওয়া, জামা-কাপড় পরানো ও গোসল করানোসহ সবকিছু আমাকেই করতে হয়। এক কথায় তারা কিছুই করতে পারে না,’— বলেন তাহমিনা বেগম।
তিনি আরও বলেন, ‘তাদের রেখে বাড়ির বাইরে যেতে পারি না। বাইরে গেলে একজনকে ঘরেবন্দি করে, আরেকজনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে যেতে হয়। তারপরও একটু সুযোগ পেলেই বাইরে পালিয়ে যায়। প্রতিবেশীদের বাড়িতে গেলে তারাও তাড়িয়ে দেয় বা আমাকে খবর দিলে দৌড় গিয়ে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসি।’
রহিম-অলির প্রতি সবার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অবহেলার কথা উল্লেখ করে তাহমিনা বেগম জানান, আমি তাদের নিয়ে ভালোই আছি। নিজের পছন্দ, ভালোলাগা-মন্দলাগা বলে কিছুই নেই। ছেলেদের ভালো রাখাই তার সুখ। এত কষ্ট আর অবহেলা নিয়েও সুখী তিনি। কিন্তু তার চিন্তা বা কষ্ট একটাই— তার মৃত্যুর পর দুই ছেলে রহিম-অলির কী হবে?
তাহমিনা বেগমের বড় ছেলে অর্থাৎ রহিম-অলির বড় ভাই শাহাদাত হোসেন তোতার সঙ্গেও কথা হয় সারাবাংলার। তিনি বলেন, আমার আয় খুবই সামান্য। তবে মা-ভাইদের নিয়ে একসঙ্গে থাকাই আমার কাছে আনন্দের। আমার ছোট দুই ভাই প্রতিবন্ধী হিসেবে দুনিয়ায় এসেছে। কিন্তু তারাও তো একই সৃষ্টিকর্তার তৈরি। আর্থিক অনটনের কারণে অনেক সময় খারাপ লাগে, কষ্ট হয়। কিন্তু ভাইদের কখনো বোঝা মনে করিনি। ওরা একটু ভালো থাকলে সেটিই আমার সুখ।
তাদের প্রতিবেশী মো. শুকুর উদ্দিন বলেন, জন্মের পর থেকেই দেখছি তারা এমন। একেবারেই অক্ষম, কিছুই করতে পারেন না। খুব কষ্টে তাদের দিন যায়। বড় ভাই দোকানদারি করে সংসার চালায়। শত কষ্ট করে খেয়ে, না খেয়ে দিনযাপন করছেন তারা। সরকার এই এতিম পরিবারটির পাশে দাঁড়ালে তাদের জন্য খুবই ভালো হয়।
পেশায় রঙমিন্ত্রী আরেক প্রতিবেশী নূর মোহাম্মদ বাবু জানান, নিঃস্ব একটি পরিবারে জন্ম নিয়েছে দুই প্রতিবন্ধী ভাই। আট সদস্যের পরিবার হলেও আর্থিকভাবে একেবারেই শূন্য। রহিম-অলির বড় ভাইয়ের গ্রামের ছোট্ট একটি মুদি দোকানে তাদের সংসার চলে। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে তারা একটু ভালো থাকত।
স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ জনপ্রতিনিধিরাও রহিম-অলির বিষয়টি অবগত। তারা বলছেন, এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। এরই মধ্যে তারা কিছু সহায়তা পেয়েছেন। তাদের আরও সহায়তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলেও জানাচ্ছেন তারা।
গোমস্তাপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘দুই ভাইকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। আমি নিজেই তাদের বাসায় উপস্থিত হয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে দু’টি ঘর নির্মাণ করে দিতে চেয়েছি। ঘর নির্মাণ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়াও তাদের বড় ভাইয়ের দোকানের পরিধি বাড়াতে ৩০ হাজার টাকা সহায়তা করা হয়েছে।’
রহনপুর পৌরসভার মেয়র মতিউর রহমান খান মতি সারাবাংলাকে বলেন, ‘পৌর মেয়র নয়, একজন মানুষ হিসেবে তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। সবারই উচিত নিজেদের জায়গা থেকে তাদের সহায়তা করা। একদিকে দুইটি প্রতিবন্ধী সন্তান, অন্যদিকে দরিদ্র পরিবার— কঠিন পরিস্থিতি। পৌরসভা ও আমি ব্যক্তিগতভাবে এই পরিবারটির জন্য একটি স্থায়ী উপার্জনের ব্যবস্থা করতে চাই। এটি খুব শিগগিরই করা হবে।’ স্থানীয় ব্যবসায়ী, বিত্তবান পরিবার ও রাজনৈতিক নেতাসহ সবার প্রতি পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান পৌরসভার এই মেয়র।
রহিম-অলি এই যে বিরল এনসেফালোপ্যাথি রোগে আক্রান্ত, এর কি কোনো চিকিৎসা নেই? এমন প্রশ্ন জানতে চাই বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. গোলাম রাব্বানীর কাছে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, এনসেফালোপ্যাথি রোগে আক্রান্তরা অনেক সময় মায়ের পেট থেকেই এই রোগ নিয়ে আসে। তাদের চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে সঠিকভাবে খেয়াল রেখে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে তারা অনেকটাই ভালো থাকে। চলাফেরায় সহযোগিতা করলে তারা অনেকটা সুস্থ থাকে। তাই সবার উচিত তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা।
জেলা আওয়ামী লীগের এই সহসভাপতি ডা. গোলাম রাব্বানী আরও বলেন, ‘মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত— রহিম-অলির উদাহরণই তা প্রমাণ করে। তাদের বিষয়ে জানার পর মনে মনে ভেবেছি— বৃদ্ধা মায়ের মৃত্যুর পর তাদের কী হবে, কোথায় যাবে, কার কাছে থাকবে? বিষয়টি নিয়ে আমিও খুবই চিন্তিত। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব রোগীদের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। সরকারি এসব সুযোগ-সুবিধার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে এবং গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পারলে তাদের জীবনযাপন কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হবে।’
সারাবাংলা/এনএস