ঈদের পর গার্মেন্টস বন্ধ রাখা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি
১৮ জুলাই ২০২১ ২৩:২০
ঢাকা: ঈদের পর কঠোর বিধিনিষিধে গার্মেন্টসহ শিল্পকারখানা খোলা থাকবে না কি বন্ধ থাকবে তা নিয়ে ধুম্রজাল তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি দেওয়া প্রজ্ঞাপনে বন্ধের বিষয়টি স্পষ্ট করা হলেও গার্মেন্টস মালিকদের আবেদনের পর সরকারের পক্ষ থেকে এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি। শ্রমিক ও মালিকরা এ নিয়ে এখনও সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন। ফলে ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে শ্রমিকরা এখনও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। যদিও কিছু কারখানায় এরই মধ্যে তিন দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের ঈদের পরের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি।
করোনা ভাইরাসের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই পবিত্র ঈদ উল আজহা উপলক্ষে বুধবার (১৪ জুলাই) থেকে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। ওই প্রজ্ঞাপনে আগামী ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফের কঠোর বিধিনিষেধ জারির নির্দেশনাও রয়েছে। সেখানে সব পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহন বন্ধের পাশাপাশি শিল্প-কারখানাও বন্ধ রাখতে বলা হয়। তবে কোরবানির ঈদের পর থেকে শুরু হতে যাওয়া কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও গার্মেন্টস খোলা রাখার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা। বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) পোশাক নেতারা মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের দেখা করে তার কাছে চিঠিটি হস্তান্তর করেন।
প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে পোশাক মালিকরা বলেন, ‘গত রোজার ঈদে কাজের চাপ কম থাকায় ছুটিও কিছুটা শিথিল ছিল। এখন কাজের প্রচুর চাপ থাকায় ঈদে লম্বা ছুটির সুযোগ নেই। কিন্তু ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকার ঘোষিত ১৪ দিন ও ঈদেরছুটিসহ মোট ১৯/২০ দিনের বন্ধ পেলে কোনো অবস্থাতেই শ্রমিকদের কর্মস্থলে ধরে রাখা সম্ভব হবে না। শ্রমিকরা ছুটে যাবে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায়। যেগুলো করোনার রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত। ফলে এই বিশাল সংখ্যক শ্রমিক জনগোষ্ঠী ওইসব অঞ্চল থেকে কর্মস্থলে ফিরে আসলে কোভিড-১৯ সংক্রমণের মাত্রা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া ২০ দিন বন্ধের পর কারখানা খোলার সঙ্গে সঙ্গে জুলাই মাসের বেতন পরিশোধের বিষয়টিও সামনে চলে আসবে। এমতাবস্থায় আমরা মনে করছি, আসন্ন ঈদের ছুটি সংক্ষিপ্ত করে দেশের রফতানিমুখী শিল্প-কারখানাগুলো যত দ্রুত সম্ভব ঈদের পরে খুলে দিলে এই খাতটি বহুমুখী বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাবে।’
এদিকে, ঈদুল আজহার পর ২৩ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধের সময় সরকারি-বেসরকারি অফিসসহ শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। শনিবার (১৭ জুলাই) দুপুরে চুয়াডাঙ্গা-৬ বিজিবির সদর দফতরে অনুষ্ঠিত বিজিবির ৯৬তম রিক্রুট ব্যাচের সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ ইঙ্গিত দেন।
এছাড়া রোববার (১৮ জুলাই) বিকেল পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে ঈদের পর গার্মেন্টস খোলা রাখার বিষয়ে কোন ইতিবাচক ইঙ্গিত পায়নি পোশাক মালিকরা। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে লেখা চিঠির উত্তরও পাননি তারা। নিটওয়্যার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএ’র পরিচালক ফজলে শামীম এহসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ সচিবের চিঠি দেওয়ার কথা। এখনও তিনি চিঠি দেননি।’
জানতে চাইলে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঈদের পরে গার্মেন্টস খোলা না বন্ধ বিষয়টি নিয়ে আমাদের আগামীকাল (১৯ জুলাই) পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী বিচক্ষণ। তিনি বিশ্ববাজার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন। আশা করি, উনার কাছ থেকে ভালো বার্তাই পাওয়া যাবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের পোশাক শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। এখন পোশাক রফতানির মৌসুম চলছে। বিশ্ববাজারে নতুন করে চাহিদা তৈরি হয়েছে। বেশিরভাগ ফ্যাক্টরিতে প্রচুর কাজ রয়েছে। তাই এই মুহূর্তে ফ্যাক্টরি খোলা রাখা উচিত। কয়েকদিন আগের বিধিনিষেধে যদি ফ্যাক্টরি খোলা না থাকতো তাহলে বেতন-বোনাস দেওয়া সম্ভব হতো না।’
বিজিএমইএ’র বর্তমান বোর্ডের একাধিক নেতাকে মুঠোফোনে কল করা হলেও এ বিষয়ে বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখনও আমাদের কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়নি। সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আমাদের চলতে হবে। আমরা আগামীকাল ছুটি ঘোষণা করব।
এদিকে, গাজীপুরের হামীম গ্রুপের কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিধিনিষিধে ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকতে পারে এমন ইঙ্গিতে ঈদের আগে ২০ ও পরে ২২ তারিখ ওই ফ্যাক্টরি খোলা থাকবে। যারা কাজ করতে ইচ্ছুক ওই দুই দিন তারা কাজ করতে পারবে। এক্ষেত্রে তারা সার্ভিস বেনেফিট পাবেন। আর সরকার নমনীয় না হলে ২৩ জুলাই থেকে ওই গার্মেন্টস বন্ধ থাকবে।
তবে গাজীপুরের চট্টগ্রাম ডেনিমে তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ২৩ জুলাই থেকে লকডাউনে ওই ফ্যাক্টরি কীভাবে চলবে পরবর্তী সময়ে তা জানানো হবে।
গাজীপুরের একটি বায়িং হাউজে কাজ করেন জোনায়েত উল্লাহ রনি। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এখনও নিতে পারিনি। প্রজ্ঞাপনে ঈদের পর গার্মেন্টস বন্ধ থাকার কথা বলা হলেও মালিকরা তো সরকারের কাছে আবেদন করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে রোববার (১৮ জুলাই) পর্যন্ত বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। ফ্যাক্টরির পক্ষ থেকে এখনও তাই ছুটি ঘোষণা করা হয়নি। ঈদের পর ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকলে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত অফিস করতে হবে। আর ঈদের পর খোলা থাকলে সোমবার (১৭ জুলাই) দুপুর পর্যন্ত কাজ করতে হবে। তাই ঈদের ছুটি নিয়ে আমরা এখনও ধোঁয়াশায় আছি।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান ইসমাইল সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে সবকিছু বন্ধ থাকলেও গার্মেন্টস চালু রাখা হয়েছিল। বিগত দুই ঈদে শ্রমিকরা গ্রামে যেতে পারেনি। এবার সরকার ঘোষণা দিয়েছে ঈদের পর গার্মেন্টস বন্ধ থাকবে। এটা মালিকদের মেনে নেওয়া উচিত। এখন শ্রমিকদের ছুটি না দেওয়া অন্যায়। উৎপাদন বা মুনাফার জন্য শ্রমিকদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হবে না। যেহেতু সরকার ঘোষণা দিয়েছে, সেহেতু এটা মালিকদের মানতে হবে। শ্রমিকরা গত দেড় বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছে। তাদেরও তো পরিবার আছে, নিজস্ব জীবন আছে, তাদেরও তো শরীর। আমি মনে করি সরকারের ঘোষণা মালিকদের মেনে নেওয়া উচিত।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘জীবন ও জীবিকার দুটি বিষয়ই আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। ঈদে গার্মেন্টস শ্রমিকরা গ্রামে গেলে কীভাবে ফিরে আসবে তা আমাদের ভাবতে হবে। যদি দীর্ঘমেয়াদি ছুটি দেওয়া হয় শ্রমিকরা বেতন পাবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। ছুটির বিষয়টি এখনও সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট না করায় শ্রমিকরা এখন উদ্বিগ্ন। লকডাউন যদি কয়েকদিন পিছিয়ে দেওয়া হতো তাহলে শ্রমিকরা ঈদ করে কাজে ফিরতে পারতো।
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম