‘এত মৃত্যু কখনও দেখিনি’
১৯ জুলাই ২০২১ ১০:৪২
ঢাকা: খুলনা শহর এবং তার আশেপাশের এলাকায় নভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড ১৯ প্রতিদিনই সংক্রমিত হচ্ছে মানুষ। বাড়ছে মৃত্যুর হারও।
খুলনা শহরের সাতটি কবরস্থানের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এর আগে এত মৃত্যু তারা দেখেননি। এ যেন লাশের মিছিল। কিছুক্ষণ পরপরই লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স আসছে কবরস্থানে।
খুলনার করোনা পরিস্থিতি বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়ে রাজনীতিবিদ এবং ডাক্তারদের অভিমত— সচেতনতা বাড়াতে সরকারের সংস্থাগুলো ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। লকডাউন শিথিল করার নামে সবকিছু উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ঈদের ১৫ দিন পরে রেজাল্ট ভয়াবহ হবে।
টুটপাড়া কবরস্থানের নিবন্ধক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘খুলনার অবস্থা খুবই করুণ। কখনও একসঙ্গে ১০টি, কখনও ১২টি, কখনও ২/১ জনকে দাফন করাচ্ছি। গত দেড় মাস ধরে এভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষগুলোকে দাফন করে আসছি।’
লবণচরা কবরস্থানের নিবন্ধক মো. সোলাইমান হোসাইন, বলেন, ‘খুলনায় মৃত্যু হার অনেক বেশি। গত দেড় মাস ধরে প্রতিদিন গড়ে সাতজনকে দাফন করছি। এরা সবাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।’
খুলনা শহরের বসুপাড়া কবরস্থানের নিবন্ধক রুহুল আমিন জানান, গত ৪৫দিন ধরে খুলনায় করোনা উপসর্গ নিয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে ৪০ জন মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা হয়েছে। সম্প্রতি মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে।
গোয়ালখালী কবরস্থানের নিবন্ধক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার চাকরি জীবনে এত লাশ কখনো দেখিনি। মনে হচ্ছে লাশের মিছিল আসছে। এই সপ্তাহে গোয়ালখালী কবরস্থানে ৩৩ জন, আগের সপ্তাহে ৪৬ জন, তার আগের সপ্তাহে করোনা সংক্রমিত ৪২ জনকে দাফন করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। বর্তমানে ছুটিতে আছি। জরুরি ডাক পড়লে কবরস্থানে যেতে হয়।’
এদিকে স্থানীয় সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে— খুলনা শহরের পরিস্থিতি দিন আর দিন অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ও ব্ল্যাক ফাঙ্গাসও ছড়িয়ে পড়েছে।
শহরের প্রতিটি ঘরে সর্দি কাশি শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। খুলনা শহরের আশেপাশের উপজেলায়ও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি।
স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক জানিয়েছেন— সরকারের জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো নয়। তাদের কাগজ-কলমে জনসচেতনতার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। মাক্স পরছে শতকরা ২০ ভাগ মানষ। এদের মধ্যে ও ১/২ শতাংশ মানুষ মাক্স মুখে না পরে থুতনিতে পরছে।
খুলনা মহানগরীর হাসপাতালে অনেকেই বলেছেন, ভ্যাকসিন গ্রহণ করার সময়ও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে। ৮০০ জনকে ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য ডাকা হলে সেখানে হাজির হচ্ছেন আড়াই হাজার মানুষ। যে ব্যক্তি ভ্যাকসিন নেবেন তার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য কিংবা ভ্যাকসিন দেওয়া দেখার জন্য যাচ্ছেন আরও ৩/৪ জন মানুষ। কেউ কেউ উৎসাহী হয়ে ভ্যাকসিন কেন্দ্রে যাচ্ছে।
খুলনার করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির খুলনা জেলার নেতা ডাক্তার মনোজ দাস বলেন, ‘আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে মনে করি সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সরকার তা করতে পারিনি। সরকারের তেমন প্রচেষ্টাও নেই। যেটুকু প্রচেষ্টা আছে তাও খুব দুর্বল।’
তিনি বলেন, ‘মানুষ যে সব মাস্ক পরছে তা পুরনো। দরিদ্র মানুষ যে মাস্ক পরছে তা কার্যকর নয়। সুতরাং মানুষের মাঝে নতুন মাস্ক দিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া ভ্যাকসিনের কোনো বিকল্প নেই। ভ্যাকসিন নিয়ে সরকারের সুদৃঢ় পরিকল্টনা বা মাস্টার প্ল্যান নেই।’
ডাক্তার মনোজ দাস বলেন, ‘মানুষের সচেতনতার সঙ্গে জীবন-জীবিকার বিষয়টিও যুক্ত। এ বিষয়টি সরকারের খেয়াল রাখতে হবে।’
খুলনা সিভিল সার্জন নিয়াজ মাহমুদ বলেন, ‘পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন মজুদ আছে। জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য প্রচার অভিযান চালানো হচ্ছে। বর্তমানে পরিস্থিতি মোটামুটি অবস্থায় রয়েছে। আশা করি, অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। ‘
খুলনার জেলা প্রশাসক মনিরুজ্জামান বলেন, ‘গত সপ্তাহের চেয়ে এই সপ্তাহে করোনার প্রকোপ কমেছে। আমরা আশা করি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করার জন্য জেলা তথ্য অফিস ব্যবস্থা নিয়েছে। পুলিশ প্রশাসন কাজ করছে। প্রতিটি মসজিদে এবং জুমার খুতবায় সচেতনতার বিষয়টি প্রচার করা হয়ে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিন কেন্দ্রে অহেতুক ভিড়ের বিষয়টি প্রশাসনের নজরে এসেছে। এটি কমানো হবে।’
সারাবাংলা/এইচএইচ/একে