মোড়ে মোড়ে কোরবানির মাংসের হাট
২১ জুলাই ২০২১ ২৩:৫১
ঢাকা: কোরবানির মাংসের একটি নির্দিষ্ট অংশ পেয়ে থাকেন সমাজের দুস্থ-অসহায় মানুষেরা। সেই মাংস থেকে কেউবা প্রয়োজনমতো রেখে দিচ্ছেন খাবারের জন্য, বাড়তি যে মাংস তা কেউ কেউ বিক্রি করে দিচ্ছেন আর্থিক জোগানের আশায়। কোরবানির দিনে কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে পাওয়া এ সব মাংস নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে ঈদের দিন বসে মাংসের হাট। মাংসের দাম কোথাও দাম একদম পানির মতো, মধ্যসত্বভোগীর দৌরাত্ম্যের কারণে আবার কোথাও দাম চড়া।
মাংসের প্রকারভেদে দাম কেজিপ্রতি ২০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। ক্রেতাদের অভিযোগ— আগের বছরগুলোতেও এ ধরনের মাংস সস্তায় কিনতে পারতেন নিম্নবিত্ত লোকজন। এবার মাঝখানে দালাল-ফড়িয়ার আধিপত্য থাকায় মাংসের দাম চলে গেছে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
ঈদের দিন বিকেল থেকে এসব হাটে বেচাকেনা শুরু হয়ে চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। প্রধানত নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোকজন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে কোরবানির মাংস সংগ্রহ করে এসব হাটে বিক্রি করেন। যাদের কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই তারাই মূলত এ সব মাংসের ক্রেতা।
বুধবার (২১ জুলাই) সন্ধ্যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ সংলগ্ন রাস্তার ফুটপাতে দেখা গেছে, বিরাট জটলা। ভিড় ঠেলে ঢুকে সেখানে দেখা যায় বিভিন্ন লোকজন ভ্যান গাড়িতে করে ও পলিথিন বিছিয়ে মাংস বিক্রি করছেন। এ সব মাংস তারা বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে কিংবা কসাইগিরির মাধ্যমে পেয়েছেন। মাংসগুলো বিক্রি করার জন্য তারা ফুটপাতে বসেছেন।
একই চিত্র দেখা গেছে— রাজধানীর আগারগাঁও বিএসইসি ভবনের উল্টো দিকে প্রধান সড়কের ফুটপাতেও। এ ছাড়াও খিলগাঁও রেললাইন সংলগ্ন এলাকার প্রধান সড়কের ফুটপাত থেকে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে কোরবানির মাংস বেচাকেনা করতে দেখা গেছে।
জানা গেছে, সাধারণ মানুষ কম দামে এ সব স্থান থেকে মাংস কেনেন। বিশেষ করে যেসব স্বল্প আয়ের লোকজন সামর্থের অভাবে কোরবানি দিতে পারছেন না। অথবা মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে লোকলজ্জায় মাংসও সংগ্রহ করতে পারেন না। মূলত তারাই ফুটপাত থেকে কোরবানির মাংস ক্রয় করে থাকেন।
এ ব্যাপারে জামাল আহমেদ নামের একজন ক্রেতা (বিস্তারিত পরিচয় দিতে অনীহা) সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে চাকরি হারিয়েছে, প্রতি বছর কোরবানি দিলেও এবার সে সামর্থ্য নেই। তাই বাধ্য হয়ে কম দামে ফুটপাত থেকে মাংস কিনতে এসেছি।’
তিনি বলেন, ‘পরিবারকে হয়ত বলা হবে না, যে মাংস ফুটপাত থেকে মাংস কিনেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘চার কেজি মাংস কিনেছি ১৪০০ টাকা দিয়ে, মাংসের মান মোটামোটি ভালো। এই মাংস কসাইয়ের দোকান থেকে কিনলে ২ হাজার থেকে ২৪০০ টাকা লাগতো।
অন্যদিকে একই এলাকার মাংস বিক্রেতা ফজল আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমিসহ কয়েকজন মিলে সারাদিনে চারটি গরু কেটেছি। এই চারটি গরু থেকে আমি প্রায় ছয় কেজি মাংস পেয়েছি। পরিবার গ্রামের বাড়িতে থাকায় এ মাংস বিক্রি করতে এসেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাছে থাকা মাংসের মান ভালো, কারণ প্রতিটি ৮০ থেকে দেড় লাখ টাকা দামের গরুর মাংস আমি বিক্রি করছি।’
অন্যদিকে রাজধানীর আগারগাঁও এলাকার বিএসইসি ভবনের বিপরীত পাশের ফুটপাতে মাংস বিক্রি করছেন রহিমা বেগম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি মানুষের বাসায় কাজ করি। ঈদের দিন আমার দুই সন্তান এবং আমার স্বামী মিলে মাংস সংগ্রহ করতে বের হয়। চারজন সারাদিন ঘুরে ১৫ কেজির মতো মাংস পেয়েছি। এর মধ্যে ১০ কেজির মতো মাংস বিক্রি করেছি। বাকি মাংসগুলোও বিক্রি হয়ে যাবে আশা করি।
মাংসের হাটে ‘মিডল ম্যান’
সরেজমিনে ঘুরে বেশ কয়েকটি মাংসের হাটে মিডল ম্যানদের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তারা দুস্থ মানুষদের কাছ থেকে কম দামে মাংস কিনে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন বেশি দামে। ফলে মাংসের হাট অনেকাংশে তাদের নিয়ন্ত্রণেই।
ক্রেতা ও বিক্রেতারা জানান— এর আগে এই মধ্যসত্বভোগী কেউ ছিল না।
বুধবার (২১ জুলাই) ঈদের দিন দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত রাজধানীর পুরান ঢাকার লোহারপুল মোড়, রায় সাহেব বাজার মোড়, তাঁতীবাজার, মগবাজার, মালিবাগ রেলগেট, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকার বেশ কয়েকটি মাংসের হাট ঘুরে এ সব চিত্র দেখা যায়।
লোহারপুল মোড়ে মাংস কিনতে এসেছেন আফরোজা মলি। আব্বাস নামে এক ব্যক্তি ৭ কেজি মাংস নিয়ে একটি ব্যাগে করে হাজির হলেন। নিমিষেই লোকটিকে ঘিরে ধরলেন লোকজন। কেউ ৫০০ টাকা, কেউ ৬০০ আবার কেউ ৬৫০ টাকা দাম বললেন। ওই লোকটি ৭০০ টাকা কেজির কমে মাংস ছাড়বেন না। এরপর সবাই সরে গেলেন।
আফরোজা এগিয়ে গিয়ে জানান, তিনি কোরবানি করতে পারেননি। তার মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন আসবেন। এ জন্য তার মাংসগুলো দরকার। তিনি ৬৫০ টাকা কেজি দাম বললেন। ওই নারীকে মাংস দিতে চাইলেও মধ্যসত্বভোগীর জন্য দিতে পারছেন না। কারণ তারাও ৬৫০ টাকা কেজিই বলেছেন। তারা মাংসগুলো নিয়ে ৭০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করবেন। অবশেষে একজনের মধ্যস্থতায় মাংসগুলো ওই নারীকে দেওয়া হলো।
লোহারপুল মোড়ে এবার মধ্যসত্বভোগী বেশ কয়েকজন বসেছেন। তারা রীতিমতো ডিজিটাল বাটখারা ও টেবিল বসিয়েছেন। অল্প অল্প করে আনা বিক্রেতাদের কাছ থেকে মাংস কিনে নিয়ে সবগুলো একখানে করে তা ক্রেতাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করছেন।
জানতে চাইলে মধ্যসত্বভোগী জামাল উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কী করব বলেন। কতদিন ধরে লকডাউন চলছে। কোনো কাম কাজ নেই। তাই হঠাৎ বুদ্ধি এলো, একদিন সামান্য কিছু যদি টাকা আসে। তবে কেউ দাম ছাড়ে না। দেখা যায়, ২০ টাকা বা ৩০ টাকার বেশি কেজিতে লাভ করা যায় না। কারণ যারা বিক্রি করবে তারাও দাম ছাড়ে না। আবার যারা কিনবে তারা তো বেশি দামে কিনতে চান না।’
মাংস বিক্রেতা নজরুল তরফদার বলেন, ‘আমি দুই বাড়িতে কসাইয়ের সহযোগী ছিলাম। বেশ কিছু মাংস পেয়েছি। বাসার জন্য কিছুটা রেখেছি। বাকিটা বিক্রি করব। যারা এবার কোরবানি দিতে পারেননি তাদের কাছে বিক্রি করতে চাই। কিন্তু মধ্যসত্বভোগী থাকায় বড় ঝামেলা। তারা এই মাংস কিনে সেখানে লাভ করতে চায়।’
ক্রেতারাও চান না যে, মাংসের হাটে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী থাক। তারা চান, ঈদের দিন যারা নানা সমস্যার কারণে কোরবানি করতে পারে না তারা যেন অন্তত ভালোভাবে এই হাট থেকে মাংসটা কিনতে পারেন।
মোহাম্মদপুর টাউন হলে বাজারে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার একদিকের ফুটপাতে বিছানো চামড়া, আরেকদিকে মাংসের বাজার। মোহাম্মদপুরের টাউনহলের সামনে নিম্ন আয়ের মানুষের ভিড়। কেউ বা এসেছেন মাংস বিক্রি করতে আর কেউ এসেছেন অল্প দামে কিনতে। এদেরই একজন গৃহসহকারী বানেছা। বাড়িতে এক ছেলে আর দুই নাতি রয়েছে। এসেছেন তাদের জন্য মাংস কিনতে।
ঈদের বিকেলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বানেছার মত নিম্ন আয়ের মাংস ক্রেতা আর বিক্রেতার ভিড় জমে ওঠে এই কোরবানির ঈদে। মোহাম্মদপুরের টাউনহলের সামনে সারাদিন ধরে বাড়ি বাড়ি থেকে চেয়ে আনা কোরবানির মাংস বিক্রি করতে এসেছেন অনেকেই। তবে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য হলেও দাম যেন তাদের নাগালেরই বাইরে। আসলে যাদের পক্ষে শারীরিক অসুস্থতা বা নানা কারণে বাড়ি বাড়ি যেয়ে মাংস সংগ্রহ সম্ভব না, এখানে ক্রেতা মূলত তারাই। কিন্তু দাম শুনে খালি হাতে চলে যেতে হচ্ছে অনেককেই।
ছয়শ থেকে সাতশ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে এই মাংস। বিক্রেতাদের কাছে জানা গেল তারা নিজেরাই কিনে এসেছেন তাই দাম একটু বেশিই পড়ছে। চর্বি-নাড়িভুড়িসহ মাংসের দাম কিছুটা কম পড়লেও মূল মাংস অনেকে সাতশ বা তার বেশিও চাচ্ছেন। ফলে দরদাম চলছেই।
কোরবানির পশুর মাংস তিন ভাগ করে এক ভাগ আত্মীয় ও গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার নিয়ম। এই শহরে অসংখ্য পশু কুরবানি হলেও বানেছাদের মত অনেকেরই ঈদের বিকেলে জমানো কিছু টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে একটুখানি মাংস।
প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে, রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট, মগবাজার আর মিরপুর এলাকাতেও। আর তাতী বাজার এলাকায় তো মনে হয়েছে সেখানে যেন কত বড় মাংসের মেলা লেগেছে। পশুর পা, মাথা, ভুড়ি এবং মাংস কোনো কিছুর অভাব নেই। রাজধানীর অন্যান্য কুড়ানো মাংসের হাটের চেয়ে তাতী বাজার হাটে দাম কিছুটা কম দেখা গেছে।
তাঁতীবাজার থেকে মাংস কিনেছেন রবিউল ইসলাম। তার তিন সন্তান, স্ত্রী আর বৃদ্ধা মা রয়েছেন ঘরে। তাদের জন্য ঈদের মাংসের স্বাদ দিতেই হাটে এসেছেন। মাংস কিনেছেন কেজি তিনেক। দরদাম করে কেনা তাই একটু কমে পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তিন কেজি মাংস কিনতে তাকে টাকা দিতে হয়েছে ১৩০০। আবার যারা টেবিল পেতে মাংস বিক্রি করছেন, তারা ৫০০ বা ৫৫০ টাকার কমে মাংস দিতে চাইছেন না।
ধনী-গরিবের এই সামাজিক বৈষম্যের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সালমা শারমিন বলেন, ‘আমাদের সমাজে একটা বৈষম্য রয়েই গেছে। এই বৈষম্যের কারণেই আজ এ ধরনের হাটের সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ সুযোগে কিছু মানুষ ঈদের মাংসের যে স্বাদ তা পাচ্ছে।’
সারাবাংলা/জিএস/ইউজে/একে