বিধিনিষেধের আগেই ঢাকায় ফেরার তোড়জোড়
২২ জুলাই ২০২১ ২৩:০৬
ঢাকা: ঈদুল আজহায় নারীর টানে বাড়ি ফেরার মানুষেরা ঈদের পরদিনই ফিরতে শুরু করেছেন কর্মস্থল রাজধানী ঢাকা শহরে। কেননা ২৩ জুলাই থেকে দুই সপ্তাহের জন্য শুরু হচ্ছে কঠোর বিধিনিষেধ। এই বিধিনিষেধ চলবে ৫ আগস্ট। এই সময়ে বন্ধ থাকবে সব ধরনের গণপরিবহন। আজকের মধ্যে ঢাকায় না ফিরলে ১৪ দিনে আর ফেরা হবে না— এই চিন্তায় ফেরার তোড়জোড় শুরু করেছেন ঢাকামুখী মানুষেরা। নগরীর সবগুলো বাস টার্মিনালে গ্রামফেরত মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে।
আবার কঠোর বিধিনিষেধের ঘোষণা থাকায় ঢাকা থেকে ঈদের পরদিন গ্রামে ছুটতে শুরু করেছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। এদের অধিকাংশ মানুষজন ঈদের দিন কোরবানি ব্যবস্থাপনা কিংবা ঈদ উপলক্ষে উপার্জনকাজে নিয়োজিত ছিলেন। বিধিনিষেধে তেমন কোনো কাজ থাকবে না এই ভেবে নিম্নআয়ের মানুষেরা গ্রামে ছুটছেন অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য।
এদিকে কঠোর লকডাউন বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সরকার ঈদের আগে বিধিনিষেধ শিথিল করায় সব শ্রেণির মানুষ সুন্দরভাবে ঈদ উদযাপন করতে পেরেছেন। পশুর হাটগুলোতে ভালোভাবে কোরবানির পশু কিনতে পেরেছেন। এরপর দিন ২৩ জুলাই থেকে বিধিনিষেধ শুরু হবে। শেষ হবে ৫ আগস্ট। এটা পূর্ব নির্ধারিত প্রজ্ঞাপন। এই ইস্যুতে গুজবে কান দেবেন না।’
বিধিনিষেধের সময় সব অফিস বন্ধ থাকবে। সরকারি ও বেসরকারি অফিস, শিল্প কারখানাসহ সারা দেশে সব ধরনের গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ থাকবে।
শুক্রবার থেকে বিধিনিষেধ থাকায় ঢাকায় ছুটছে মানুষ। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই দৌলতদিয়া ঘাটে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার ঢাকামুখী মানুষের চাপ শুরু হয়েছে।
দের পরদিনের মধ্যে ঢাকায় ফিরতে না পারলে বাড়িতে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন।
দৌলতদিয়ায় গাড়ির সারি: সারাবাংলার মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ঢাকামুখী মানুষের চাপ থাকায় বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের দৌলতদিয়া ঘাটে অন্তত ৫ কিলোমিটার যানবাহনের সারি তৈরি হয়েছে। ফলে ঢাকামুখী নারী-শিশুসহ হাজার হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন।
মেহেরপুর-ঢাকা রুটে চলাচলকারী মেহেরপুর ডিলাক্সের বাসচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা থেকে গ্রামে যাওয়া মানুষ মাত্র একদিন সময় পেয়েছে। ঈদের পরদিনই তাদের ঢাকায় ফিরতে হচ্ছে। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় গাড়ির চাপ থাকায় ঢাকায় যেতে বেশি সময় লাগবে।’
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া অফিস জানায়, নদী পার হতে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অতিরিক্ত যানবাহন দৌলতদিয়া ঘাটে আসছে। এতে করে যানবাহনগুলোকে ফেরি পেতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
দৌলতদিয়া ঘাটে কর্মরত বিআইডব্লিউটিসি’র ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. শিহাব উদ্দিন বলেন, বর্তমান এই নৌরুটে মোট ১৬টি ফেরি সার্বক্ষণিক যানবাহন পারাপার করছে। তারপরও বাড়তি যানবাহনের কারণে ঘাট এলাকায় বেশ কিছু গাড়ি আটকা পড়েছে।
দ্বিগুণের বেশি ভাড়া দিয়ে মানুষ ফিরছেন: বৃহস্পতিবার (২২জুলাই) বিকেলে গাবতলী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ফিরছেন মানুষ। যারাই ফিরছেন তারাই আবার বলছেন, দ্বিগুণেরও বেশি ভাড়া দিয়ে রাজধানীতে এসেছেন। এদিকে রাজধানী থেকে যারা রাতে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে চান তারাও বিপাকে পড়েছেন কারণ কোনো বাসেরই আসন নেই।
সিরাজগঞ্জ থেকে রাজধানীতে এসেছেন হোসেন মিয়া। চট্টগ্রামে অফিস। বিধিনিষেধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি কর্মস্থলের দিকে রওয়ানা দিয়েছেন। কিন্তু ঢাকায় এসে চট্টগ্রামের কোনো বাসেরই সিট পাচ্ছে না। ভাড়া যা-ই হোক তাকে যেতেই হবে, কিন্তু নিরূপায় বাস কাউন্টারগুলোও বলছে, এই মুহূর্তে তাদের কাছে কোনো আসন খালি নেই।
পাবনা থেকে ঢাকা এসেছেন ইমন। তিনি বলেন, ‘অফিস ২৭ তারিখ থেকে খোলার কথা। কাল থেকে যদি বিধিনিষেধ হয় তাহলে গ্রাম থেকে আসতে পারব না। তাই আজকে ঈদের পরদিন ঢাকায় চলে আসছি।’
আসার পথের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কোনো বাসের আসন পাওয়া যাচ্ছিল না। খুব কষ্ট করে আসনের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। আসা যাওয়ার মাঝে কষ্ট হলেও একটিই আনন্দ যে বাড়ির সবার সঙ্গে এবারের ঈদ করতে পেরেছি।’
রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসেছেন রফিকুল ইসলাম। ঈদের পরদিনই কেন আসলেন জানতে চাইলে বলেন, ‘না এসে কি আর উপায় আছে? সবাই বলাবলি করেছে, কাল থেকে গাড়িঘোড়া চলবে না। তাই আজকেই চলে এসেছি। এদিকে গার্মেন্টেস থেকেও বলা হয়েছে আগামী সপ্তাহ থেকে খুলবে। তাই বাধ্য হয়েই আজকে ঢাকায় আসছি।
এভাবে অসংখ্য মানুষ ঈদের দ্বিতীয় দিনেই ঢাকায় আসছেন। তারা সবাই একই কথা বলছেন বেশি ভাড়ায় যেমন আসছেন তেমনিভাবে বিধিনিষেধের ভয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন।
কিছুটা সুনসান কমলাপুর রেলস্টেশনে: রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে যাত্রীচাপ কম দেখা গেছে। কঠোর বিধিনিষেধ শুরুর আগের দিন এবং পবিত্র ইদুল আজহার পরের দিন হওয়া সত্ত্বেও রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে আসা যাওয়া যাত্রীদের কোনো বাড়তি চাপ ছিল না। করোনাবিহীন স্বাভাবিক সময়ে স্টেশনটি যাত্রীদের আনাগোনায় মুখরিত থাকলেও এবার তার সম্পন্ন বিপরীত চিত্র দেখা গেছে।
অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে ট্রেন চলাচল এবং সব টিকেট অনলাইনে বিক্রি করায় কমলাপুর রেলস্টেশনে ঈদের পরদিন তেমন যাত্রী উপস্থিতি ছিল না।
এদিকে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা সোয়া ছয়টা পর্যন্ত স্টেশনে অবস্থানকালে কোথাও যাত্রীদের ভিড় চোখে পড়েনি। করোনার কারণে ট্রেনের সব টিকেট অনলাইনে বিক্রি করায় বেশিরভাগ টিকেট কাউন্টারগুলো বন্ধ রয়েছে। রেলস্টেশনের ভেতরে বাইরে এবং প্লাটফর্মের ভেতর অনেকটাই সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে।
করোনা মহামারি প্রকোপ মোকাবিলায় মাস্ক ও টিকেট ছাড়া কোনো যাত্রীকে প্লাটফরমে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। যাদের অনলাইন টিকেট রয়েছে ও মাস্ক পরিধান করে আসছেন তাদেরকেই কেবল স্টেশনের প্লাটফর্মের ভেতর প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে। ফলে পুরো স্টেশন এলাকায় নেই কোনো কোলাহল কিংবা যাত্রীদের আনাগোনা, নেই কোনো হকারের উৎপাত।
মানুষের স্রোত যাত্রবাড়ীতে: ঈদের দ্বিতীয় দিনে ঢাকায় ফেরা মানুষের স্রোত দেখা গেছে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায়। আবার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে আজও মানুষ গ্রামের দিকে ছুটতে দেখা গেছে। তবে ঘরে ফেরা মানুষের চেয়ে ঢাকায় মানুষের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি।
আনোয়ার হোসেন পবন সাতক্ষীরা থেকে এসে যাত্রাবাড়ীতে নেমে উত্তরার গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি জানান, ঢাকায় আসতে তার তেমন কষ্ট হয়নি। গত ১৫ জুলাই ঢাকা থেকে গ্রামে গিয়েছিলেন।’
সব বন্ধ তারপরও ঢাকায় ফিরলেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকাতেই পরিবার নিয়ে থাকি। এক স্বজন মারা গিয়েছিল আর বাবা মা গ্রামে থাকেন তাই গিয়েছিলাম। কঠোর লকডাউনে সব বন্ধ থাকবে তাই তড়িঘড়ি করে আসতে হলো।’
এনামুল হক কুমিল্লা থেকে এসে নেমেছেন সায়েদাবাদে। অপেক্ষা করছেন মিরপুরে যাবেন। তিনি একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। গ্রামে গিয়েছিলেন বাবা মায়ের সাথে ঈদ করতে। কঠোর লকডাউন শুনে তাড়াতাড়ি ডাকায় চলে এসেছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘ভেবেছিলাম সরকার দুি চারদিন শিথিল করবে। কিন্তু কোনো রকম ছাড় না দেওয়ায় চলে আসতে হয়েছে।’
যাত্রাবাড়ীতে ট্রাফিক সার্জেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বিকেল থেকেই ঢাকায় ফেরা মানুষের স্রোত লক্ষ করছি। গাড়িও আসছে স্রোতের মতো। আবার অনেকে পিকআপ ভ্যান, মাইক্রোবাসে, প্রাইভেট কারে এমনকি মোটরসাইকেলে করেও ঢাকায় আসছেন।’
তার প্রশ্ন একদিনের জন্য কেনই বা গেলেন আবার কেনই বা ছুটে আসছেন?
তিনি বলেন, ‘যারা আসছেন তাদের বেশিরভাগেরই মুখে মাস্ক নেই। স্বাস্থ্যবিধি তো কেউ মানছেই না। আবার যেসব গাড়ি আসছে প্রত্যেক গাড়িতেই ডাবল সিটে যাত্রী আনা হচ্ছে। সেখানেও কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না।’
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে কথা হয় এশিয়া লাইন পরিবহনের সহকারী কামরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা-কুমিল্লা সকাল ৬ টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ৬ বার যাতায়াত করেছেন। প্রত্যেক বারই বাস ভর্তি লোক আসা-যাওয়া করেছে।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকায় ফেরা মানুষের চাপ বেশি। আজ রাতে সারারাত বাস চলবে। আগানীকাল সকাল ৬টা থেকে আর বাস চলবে না।’
সারাবাংলা/এসজে/ইউজে/জিএস/একে