চট্টগ্রামে হাসপাতালে শয্যা সংকট, মিলছে না আইসিইউ
২৩ জুলাই ২০২১ ২০:৪৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: এক মাস ৮দিন বয়সী এক শিশু ও তার মা নভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড ১৯) আক্রান্ত। শুক্রবার (২৩ জুলাই) সকাল থেকে শিশুটির শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ— শিশুটিকে দ্রুত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করতে হবে। দিনভর খুঁজে সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে আইসিইউ পাননি স্বজনরা। শেষপর্যন্ত নগরীর মেহেদিবাগে ম্যাক্স হাসপাতালে শিশুটিকে সাধারণ কেবিনে রেখে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে।
এভাবেই চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছেন কোভিড আক্রান্ত ও তাদের স্বজনরা। কিন্তু হাসপাতালগুলোতে শয্যা খালি পাওয়া যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক থেকে দেড় সপ্তাহ ধরে কোভিড আক্রান্ত রোগী অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলো আর সেই চাপ সামলাতে পারছে না। একটি শয্যা খালি হলে ৮-১০ জন রোগীর স্বজন ভিড় করছেন। আইসিইউতে এই চাপ আরও বেশি।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোগীর চাপ অস্বাভাবিক বেড়েছে। নরমাল সিটেও চাপ বেশি। আইসিইউতে যত রোগী ভর্তি আছেন, ওয়েটিংয়ে আছেন সমপরিমাণ। সরকারি হাসপাতালে এ মুহূর্তে আইসিইউ শয্যা খালি নেই। বেসরকারিতে কিছু আছে। তবে সেখানে তো সব রোগী যেতে পারেন না। আমরা হাই ফ্লো নজল ক্যানোলা, অক্সিজেন আর এইচডিইউ সুবিধা রোগীদের যতটুকু পারছি দিচ্ছি। আইসিইউতে সিট খালি হলে রোগীর অবস্থা বুঝে যার অবস্থা বেশি খারাপ তাকে সেখানে পাঠাচ্ছি।’
শুক্রবার (২৩ জুলাই) গণমাধ্যমে পাঠানো জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী— চট্টগ্রামে গত ২৪ ঘন্টায় ১ হাজার ৬৬১ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৪২৮ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নগরীর ৩০২ জন ও ১২৬ জন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। একইসময়ে মৃত্যু হয়েছে দুইজনের।
চট্টগ্রামে গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিনই ৮০০-৯০০ জন করে করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। রেকর্ড পরিমাণ মৃত্যু হয়েছে গত দুই সপ্তাহে।
সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে— শুক্রবার পর্যন্ত চট্টগ্রামে মোট ১ হাজার ২৬০ জন করোনায় আক্রান্ত রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এর মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালে আছেন ৮০৩ জন।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিআইটিআইডিসহ কোনো সরকারি হাসপাতালে কোভিড ইউনিটে সাধারণ শয্যা এবং আইসিইউ শয্যা খালি নেই। জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতাল করা হয়েছে। হলি ক্রিসেন্টসহ কয়েকটি হাসপাতালে কিছু শয্যা ফাঁকা আছে। কিন্তু সেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানোলা এবং আইসিইউ সুবিধা না থাকায় রোগী ভর্তির পরিমাণ এমনিতেই কম বলে জানা গেছে।
সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি সারাবাংলাকে বলেন, ‘জেনারেল হাসপাতাল, বিআইটিআইডি, চমেক হাসপাতাল মিলিয়ে ৪৩টির মতো আইসিইউ শয্যা আছে। সেখানে ৩৫টিতে রোগী আছে। হলি ক্রিসেন্টে রোগী যাচ্ছে না। সেখানে অক্সিজেন ফ্লো একটু কম। চেষ্টা করছি হাই ফ্লো নজল ক্যানোলা দিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করার। নরমাল বেডের মধ্যে জেনারেল হাসপাতালের ১৫০ বেডের সবগুলোতে রোগী আছে। চমেক হাসপাতালের ৩০০ বেড ফিলআপ হওয়ার পর আরও ১০০ রোগী ভর্তির কথা বলা হয়েছে। সেখানে শয্যা বাড়ানো হচ্ছে। অন্য কোথাও খালি নেই বেড।’
সিভিল সার্জন বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড ইউনিটে আইসিইউ ও সাধারণ শয্যা খালি থাকার কথা বলেছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ ভালো মানের বেসরকারি হাসপাতালেই শয্যা খালি নেই। নগরীর জিইসিতে মেডিকেল সেন্টারে মোট ৪৪টি শয্যা আছে। এর মধ্যে ৭টি আইসিইউ শয্যা সবগুলোতেই রোগী আছেন। বরং আইসিইউতে নেওয়ার মতো দু’জন রোগী এখন অপেক্ষমাণ আছেন। নগরীর আগ্রাবাদে মা ও শিশু হাসপাতালে ২৭টি আইসিইউ ও এইচডিইউসহ প্রায় ২০০ করোনা রোগী রাখা ভর্তি আছেন। এরপরও হাসপাতালটিতে আরও রোগী ভর্তির চাপে আছে।
মেহেদিবাগে ম্যাক্স হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ শয্যা আছে। রোগী আছে ১৫ জন। পাঁচজনকে আইসিইউতে নিতে না পেরে এইচডিইউ ও হাই ফ্লো নজল ক্যানোলা দিয়ে রাখা হয়েছে। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিয়াকত আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেড়-দুই সপ্তাহ ধরে অস্বাভাবিক চাপ। একটি আইসিইউ বেড খালি হলে ৮-১০ জন এসে বুকিং দেওয়ার চেষ্টা করেন। একটি নরমাল বেড খালি হলে ১০-১৫ জন কোভিড রোগীর আত্মীয়স্বজন আসেন ভর্তি করানোর জন্য। অবস্থা এমন হয়েছে, যত রোগী ভর্তি আছেন, ওয়েটিংয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি। খুবই খারাপ অবস্থা।’
লিয়াকত আলী আরও বলেন, ‘আজ (শুক্রবার) সকাল থেকেও আমরা এক মাসের এক বাচ্চাকে আইসিইউতে নেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনোভাবে আইসিইউ বেড খালি হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত আমরা নরমাল কেবিনে রেখে তাকে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সাপ্লাই দেওয়ার চেষ্টা করছি। আইসিইউতে একটা বেড খালি হওয়ার জন্য তার অভিভাবকরা অপেক্ষা করছেন। এ ধরনের ক্রাইসিস আমাদের পার করতে হচ্ছে।’
নগরীর পাহাড়তলীতে বেসরকারি ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে ১৪টি কোভিড আইসিইউ বেড আছে। এর মধ্যে ২টি আছে ভেন্টিলেশন সুবিধাসহ। কোভিড রোগীদের জন্য ৪৬টি কেবিন আছে। ২৭টি এইচডিইউ বেড আছে।
ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের কোভিড ইউনিটের ফোকাল পারসন ও একাডেমিক কো-অর্ডিনেটর ডা. আরিফ বাচ্চু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কেবিন, আইসিইউ, এইচডিইউ কোথাও খালি নেই। শুধু দুইটি আইসিইউ বেড আমরা খালি রেখেছি আমাদের রোগীদের জন্য। আমাদের হাসপাতালে কারও পরিস্থিতির অবনতি হলে তাকে যেন বাইরে পাঠাতে না হয়, সেজন্য আমরা সেগুলো খালি রাখি।’
দুই সপ্তাহ ধরে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সীতাকুন্ড-মীরসরাই থেকে বেশি রোগী আসছে। চট্টগ্রাম শহরের রোগীও আছে। আমাদের হাসপাতালে যত কোভিড রোগী ভর্তি আছেন, তার মধ্যে অর্ধেক শহরের, অর্ধেক উপজেলার। গত ২-৩ সপ্তাহ ধরে উপজেলার রোগী বাড়ছে। তবে আমাদের হাসপাতালে মৃত্যুহার কম, এক শতাংশের মতো। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে— সাধারণ কোভিড রোগীরা যেখানে ৫-৬দিন হাসপাতালে থাকার পর সুস্থ হয়ে উঠছেন, সেখানে আইসিইউর রোগীদের ১৫-১৬ দিন, কাউকে আবার একমাসও রাখতে হচ্ছে।’
সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আইসিইউ সংকট বিশ্বের সব দেশেই আছে। এটা শুধুমাত্র আমাদের সংকট না। যে পরিমাণ রোগী, তত আইসিইউ বেড রাখা তো সম্ভব না। হাসপাতালে নরমাল বেড আরও বাড়ানোর চেষ্টা আমরা করছি। কিন্তু শুধু হাসপাতালে শয্যা বাড়িয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না। আামদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। যে বিধিনিষেধ শুরু হয়েছে, সেটি মেনে বাসায় থাকতে হবে। এই ১৪ দিন যদি কঠোরভাবে বিধিনিষেধ চলে, তাহলে অবশ্যই পজিটিভ ইফেক্ট পড়বে।’
সারাবাংলা/আরডি/একে