Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনায় বিপর্যস্ত আইনজীবীরা, পেশাও বদলাচ্ছেন কেউ কেউ

কামরুল ইসলাম ফকির, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৩ জুলাই ২০২১ ২২:৩৮

ঢাকা: গত বছরের মার্চে অবকাশকালীন ছুটি শেষ হতে না হতেই সরকার করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ রোধে ঘোষণা করে সাধারণ ছুটি। সে অনুযায়ী ২৯ মার্চ থেকে দেশের সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ ও সব অধস্তন আদালতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই কার্যত বন্ধ ছিল দেশের সব আদালত। ‘আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০’ জারির মাধ্যমে পরে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আদালতের কার্যক্রম শুরু হলেও এ পদ্ধতিতে সব আইনজীবীর কাজের সমান সুযোগ ছিল না। এতে আইনজীবীদের বড় একটি অংশ, বিশেষ করে তরুণ আইনজীবীরা পড়েছেন চরম বিপাকে। কাজ হারিয়ে অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে বেছে নিয়েছেন বিকল্প পেশাও।

বিজ্ঞাপন

আইনজীবী সমিতি ও সাধারণ আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে সদস্য রয়েছেন প্রায় সাড়ে ১০ হাজার। বর্তমানে নিয়মিত আদালত চালু না থাকার কারণে জীবিকা সংকটে পড়েছেন অধিকাংশ আইনজীবী। বিশেষ করে জুনিয়র আইনজীবীদের আয়-রোজগার একেবারে কমে যাওয়ায় তারা আর্থিকভাবে দৈন্যদশায় পড়েছেন। এ অবস্থায় তারা না পারছেন সংসার চালাতে, মান-মর্যাদার কথা ভেবে না পারছেন কারও কাছে হাত পাততে।

বিজ্ঞাপন

গত কয়েক দিনে বাংলাদেশ বার-কাউন্সিল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, আইনজীবী নেতা ও অন্তত অর্ধশত সাধারণ আইনজীবীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের সবার বক্তব্য, সীমিত পরিসরে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আদালতের কার্যকম পরিচালনার কারণে আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় বেশিরভাগ আইনজীবীর মাঝে এখন চরম হতাশা বিরাজ করছে। আইনজীবীদের দাবি, নিয়মিত আদালত খুলে দেওয়া হোক।

আইনজীবীদের সংকট নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আলী হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে আমরা অর্থ কষ্টে আছি। এখন মহা সংকটে পড়েছি। আয়-রোজগার না থাকায় অনেকে আইন পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত আদালত বন্ধ। কোনো আয় না থাকলেও আইনজীবীদের চেম্বার ভাড়া, বার কাউন্সিল, বার অ্যাসোসিয়েশনের ফি কিংবা ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজের বেতন মাফ নাই। এছাড়াও বাসা ভাড়া, আইনজীবী সহকারীর বেতন তো আছেই। আয় না থাকলে এত টাকা কোথায় পাব? আমরা এখন দিন আনি দিন খাওয়া মানুষের চেয়েও বেশি অসহায় হয়ে পড়েছি। সব কিছু মিলিয়ে আমরা চরম হতাশার মধ্যে আছি।’

গত এক বছর চার মাস ধরে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সারা দেশের অসচ্ছল ও জুনিয়র আইনজীবীদের জন্য আর্থিক অনুদান চেয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী।

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সারাদেশের অসচ্ছল ও জুনিয়র আইনজীবীরা চরম আর্থিক সংকটে দিন কাটাচ্ছেন। অধিকাংশ জুনিয়র ও অসচ্ছল আইনজীবী বাড়ি ভাড়া, চেম্বার ভাড়া, হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে পারছেন না। এসব মানবিক বিষয় বিবেচনা করে অন্তত ৬০০ কোটি টাকা আর্থিক অনুদান দিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছি।’

আইনজীবীরা বলছেন, গত বছর করোনাকালে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে আইনজীবীদের আর্থিকভাবে সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। তবে এ বছর এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনজীবীদের অভিভাবক সংগঠন হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ও বার কাউন্সিলকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আবার দাবিও জানিয়েছেন তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুপ্রিম কোর্টের একজন তরুণ আইনজীবী বলেন, ‘সমাজে আমাদের পেশার একটি মান-সম্মান আছে। সেই মান-সম্মানের কথা ভেবে আমরা মানুষের কাছে হাত পারতে পারি না। কিন্তু আমাদের দুর্দশায় কেউ পাশে দাঁড়ানোর মতো নেই। আমরা না পারছি নিজেরা চলতে, না পারছি কারও কাছে সাহায্য চাইতে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বার কাউন্সিল কিংবা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আমাদের অভিভাবক সংগঠন। আমরা চাই, তারা আমাদের পাশে এসে দাঁড়াক। তাদের নিজেদের ফান্ড থেকে সহায়তা না করতে পারলে সরকারের সঙ্গে কথা বলুক। সরকার তো এই মহামারিতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য আর্থিক অনুদানসহ নানা ধরনের প্রণোদনা দিয়েছে। মানুষের বিচারপ্রাপ্তি যারা নিশ্চিত করেন, সেই আইনজীবীরা কেন তেমন কোনো সহায়তা সরকারের কাছ থেকে পাবে না?’

এসব বিষয়ে কথা হয় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজলের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি মনে করি করোনাকালে আইনজীবীরা সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে আছেন। আমরা সবসময় বলে এসেছি, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আমাদের আদালত চালু রাখতে হবে। আমাদের কথা হচ্ছে— করোনার সময় আপিল বিভাগ ভার্চুয়ালি চলছে, হাইকোর্ট বিভাগও ভার্চুয়ালি চলুক। এতে অসুবিধা কী? আমাদের দাবি, পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সব অবস্থায়, সব পরিস্থিতিতে আদালত সচল রাখতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমি টেলিফোনে প্রধান বিচারপতির কাছে আইনজীবীদের দুর্দশার কথা তুলেছি। করোনায় কোর্ট বন্ধ থাকায় আইনজীবীরা যে চরম আর্থিক সংকটে রয়েছে, সে কথাও বলেছি। এক দিনের জন্য প্রধান বিচারপতি ৩৮টি বেঞ্চ গঠন করে দিয়েছিলেন। এই বেঞ্চগুলো অবকাশকালীন ছুটিতেও চালু রাখার অনুরোধ জানিয়েছি। তখন প্রধান বিচারপতি বলেছেন, তিনি অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবেন।’

আইনজীবী সমিতির সম্পাদকের অনুরোধের পর ১৯ জুলাইয়ের জন্য হাইকোর্টের ৩৬টি বেঞ্চ গঠনের আদেশ দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। কিন্তু ঈদুল আজহার পর কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হলে তখনকার জন্য নতুন কোনো আদেশ নেই।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন সারাবাংলা বলেন, ‘করোনা মহামারিকালে আইনজীবীদের সহায়তা করার চেষ্টা করছি। এ জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটিতে আইনমন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসসহ আরও অনেকে আছেন। তাদের সবাইকে নিয়ে আইনমন্ত্রীর মাধ্যমে কোনো সহায়তার ব্যবস্থা করা যায় কি না, তার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি।’

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন আরও বলেন, ‘গত বছর আইনজীবীদর সহায়তা করতে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ৬ কোটি টাকা দিয়েছিল। এক কোটি টাকা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এখন বার কাউন্সিলেরও তেমন আয় নেই। আইনজীবীরা বেনাভোলেন্ট ফান্ডে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা করে থাকেন। আইনজীবী তালিকাভুক্ত করার জন্য যে ভর্তি পরীক্ষা হয়, তাতেও সামান্য আয় হয়। এখন পরীক্ষাও হচ্ছে না। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি সহায়তা করার জন্য।’

সারাবাংলা/কেআইএফ/এএম/টিআর

আইনজীবী আদালত করোনা কোভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর