ঢাকা: পথে দিন, পথে রাত। পিচ ঢালা পথই ঠিকানা। ভাগ্য তাদের পথে পথে। পথই তার শেষ ঠিকানা। রাজধানীতে এমন পথের মানুষের সংখ্যা কেউ গুনে দেখেনি। এমন কি নাগরিকত্ব নির্ধারণের ঠিকানা ও তাদের এই পথই। পথে চালিত মানুষের করুণা কৃপা তাদের জীবন ধারণের পথে হলেও পথই ভরসা।
অতিমারি করোনা পথের জীবনকেও বিপন্ন করেছে। বিপথে নিয়েছে তাদের ভাগ্য। পথবাসী মানুষদের খবর নিতে গত রোববার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে পথবাসী (ছিন্নমূল/টোকাই) মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। অতিমারি করোনায় তাদের প্রতিদিন কীভাবে চলে তা বর্ণনা করতে গিয়ে কেউ বলেছে, লাঠি উষ্ঠা খেয়ে দিন কাটে। কারো বাড়ি গেটে গিয়ে খাবার চাইবে দারোয়ানের লাথি, ঘাড় ধাক্কা আবার লাঠির পিটুনি খেতে হয়। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে চোর বলে কখনো বেঁধে রাখে। অথচ আমরা চুরি করি না, ভাঙারি টোকাই। রাস্তা ড্রেন-ডাস্টবিন থেকে ভাঙারি কুড়িয়ে দোকানে বিক্রি করি।
এই মহামারি করোনাকালে পথবাসী মানুষদের আয়ও কমে গেছে। আগে যেখানে দিনে ২/৩ শ টাকা উপার্জন করা যেতন এখন সেখানে ২০ টাকাও আয় করা যায় না। এ ছাড়া ভাঙারির দোকানগুলো বন্ধ।
এদের কেউ কেউ ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত। এটি তাদের ক্ষুধা কমানোর কৌশল। ড্যান্ডি টানলে পেটে গ্যাসজমে। কিছুক্ষণ পর আর কিছু খেতে ইচ্ছা করে না। ঘুম এলে রাস্তায়ই তারা ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে জাগার পর ক্ষুধা লাগে। এ সময় কারও বাড়ি গিয়ে খাবার খাইলে সেখান থেকে জোটে লাথি-উষ্ঠা। তখন ডাস্টবিনে বা হোটেলের ফেলে দেওয়া খাবার কুড়িয়ে খাই।
পথবাসী মেহেদীর বাড়ী ময়মনসিংহে। তার সাথে কথা হয় রোববার সকালে নয়াপল্টন বিএনপি অফিসের সামনে বসে। মেহেদী জানায়, সে গত দুই দিন ধরে কিছু খায়নি। বড় বড় গেইটওয়ালা বাড়ির সামনে গিয়ে ভাত চেয়েও পায়নি। বরং ভাত চাইতে গিয়ে দারোয়ান ধমক দিয়েছে, এরপর ঘাড়ে ধাক্কা দিয়েছে।
মেহেদী বলেন, ‘নিরুপায় হয়ে একজন পথচারীর কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। তিনি পাঁচ টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা দিয়ে বিস্কুট কিনে খেয়েছি।’
গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট পীর ইয়ামিনী মার্টের সামনে আইল্যান্ডে ঘুমায় ১০/১২ জন পথশিশু। সেখানে গিয়ে দেখা যায় তারা সবাই বসে পলিথিনে ভেতরে নেশা জাতীয় কিছু একটা মুখ দিয়ে টানছে। জিজ্ঞেস করার পর আরমান নামে এক টোকাই বলে, নেশা করছি। মনের কষ্টে ড্যান্ডি টানছি। এটি খাইলে মাথা ঝিমঝিম করে, পেটে গ্যাস হয়, ক্ষুধার কথা মনে থাকে না। একটু পরেই ঘুমিয়ে যাব।
এ সময় আরমান আরেক পথশিশুকে দেখি বলে, ওই যে দেখুন, ও ঘুমিয়ে গেছে!
আরমান বলে, ‘কাল সকালে একটা পরোটা খেয়েছি। আজ সকালে মুড়ি কিনে খেয়েছি। গোলাপশা মাজারে লকডাউনের কারণে কেউ খবার (শিন্নি) নিয়ে আসে না। তাই ভাগ্যে খাবার জোটেনি। সমস্ত দিন রাস্তা থেকে বোতল, টিনের কৌটা, কাগজ এসব কুড়াই। আগে প্রতিদিন ৩০০ টাকা/২০০ টাকায় আয় করতাম। পেট ভরে খাইতাম। এখন পেট ভরে খেতে পাই না।’
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ১২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা বেশি।
অতিমহামারিতে এ সব ছিন্নমুল মানুষের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ বলেন, ‘অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব টাকা জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো হয়েছে। কেউ ৩৩৩ নম্বরে ফোন করলে তাকে খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকার টোকাই বা পথবাসী মানুষের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্রলীগ, যুবলীগ খাবার বিতরন করছে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকার এই খাতে যে বরাদ্দ দিয়েছে তা সামান্য। এগুলো প্রচার সর্বস্ব।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকায় ২ কোটির বেশি মানুষের বাস। এদের একটি বড় অংশের এই সময়কালে জীবিকা নেই। এরা চরম দারিদ্র্যসীমায় নেমে এসেছে। এদের তালিকা ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের কাছে আছে। সরকার ইচ্ছা করলে এ সব মানুষের সহয়াতার জন্য নগদ টাকা কিংবা খাবার তাদের মাধ্যমে পরিকল্পনা করে পৌঁছাতে পারে। বর্তমানে যে অবস্থা চলছে তা অব্যহত থাকলে চরম নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে।’
জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব সাইদুর রহমান টেপা বলেন, ‘সরকার পথবাসী মানুষের জন্য( টোকাই) কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে আমার জানা নেই। ওরাও এদেশের নাগরিক। সরকারের উচিৎ ওদের দিকে নজর রাখা, পুনর্বাসন করা। শুধ সরকারই নয়, সব রাজনৈতিক দলগুলোর নজর রাখা উচিত।’
সিপিবির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘সরকার এ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রকৃতপক্ষে কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না। পথবাসী বা শিশুদের তালিকা সরকারের কাছে নেই। আমরা অনেক আগে থেকে বলে আসছি এই জনগোষ্ঠীর তালিকা করা হোক এবং তাদের পুনর্বাসন করা হোক। সরকারের দৃষ্টি সেদিকে নেই।’