মানবপাচার প্রতিরোধে সবপক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে
২৮ জুলাই ২০২১ ১৯:৫৫
ঢাকা: চলমান মহামারি এবং কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ কমাতে চলাচলের ওপর আরোপিত বিধি-নিষেধ মানবপাচারের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং বাংলাদেশি অভিবাসীদের গমনাগমনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ফলে এ বছর ‘বিশ্ব মানবপাচার বিরোধী দিবস ২০২১’ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘ক্ষতিগ্রস্তদের কণ্ঠস্বর পথ দেখায়’ (ভিক্টিমস ভয়েজেস লিড দ্য ওয়ে), যা মানব পাচারের শিকার হয়ে ফিরে আসাদের ক্যাম্পেইনের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে এবং তাদের বক্তব্য শোনা এবং সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে বুধবার (২৮ জুলাই) বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশ ইউনাইটেড নেশনস নেটওয়ার্ক অন মাইগ্রেশন (বিডিইউএনএনএম), সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা একটি ভার্চুয়াল ওয়েবিনারে আলোচনায় যোগ দেন। এ ওয়েবিনারে মানবপাচারের শিকার হয়ে বেঁচে ফেরাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরার পাশাপাশি প্রতিবছর আনুমানিক ৭ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে অভিবাসনকালে যে ঝুঁকির সম্মুখীন হন, তার ওপর আলোকপাত করা হয় হয়।
ওয়েবিনারে বলা হয়— বিপদে থাকা অভিবাসীরা প্রায়শই পাচারকারীদের টার্গেট হয়ে থাকে। অনেকেই পাচারের শিকার হয়ে ঋণের জালে আবদ্ধ, জোরপূর্বক শ্রম, যৌন শোষণ, জোরপূর্বক বিবাহ এবং আধুনিক দাসত্বের মতো পরিস্থিতির শিকার হয়। দালিলিক প্রমাণে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ মানবপাচারের শিকার পুরুষ, নারী এবং শিশুদের জন্য একটি উৎস, ট্রানজিট এবং গন্তব্য দেশ।
বাংলাদেশ সরকার নীতিমালা প্রণয়ন ও টাস্কফোর্সকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে মানবপাচার প্রতিরোধে সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জিও-এনজিও ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি টু কমব্যাট হিউম্যান ট্রাফিকিং, কমিটি টু মনিটর দ্য ন্যাশনাল প্লান অব অ্যাকশন ফর কমব্যাটিং হিউম্যান ট্রাফিকিং ২০১৮-২০২২, দ্য রেসকিউ, রিকভারি, রিপ্যাট্রিয়েশন, অ্যান্ড ইন্ট্রিগ্রেশন (আরআরআরআই) টাস্কফোর্স, দ্য ভিজিলেন্স টাস্কফোর্স, এবং দ্য কাউন্টার ট্রাফিকিং কমিটিজ অ্যাট ডিস্ট্রিক্ট, সাব-ডিস্ট্রিক্ট, অ্যান্ড ইউনিয়ন লেভেল।
ওয়েবিনারে বক্তারা মানবপাচারের বিরুদ্ধে লড়তে সরকার, বৈশ্বিক অংশীদার, বেসরকারি খাত এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের প্রতি জোরালো এবং অধিকার ভিত্তিক পন্থা অবলম্বনের আহ্বান জানান, যাতে শোষণ প্রতিরোধ করা যায় এবং মানবপাচার সংঘঠনের ক্ষেত্রসমূহ কমিয়ে আনা যায়।
ওয়েবিনারে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘মানবপাচার একটি মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে এবং এই ভয়াবহ অপরাধের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে। অভিবাসীদের পাচার এবং চোরাচালানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সব অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।’
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো বলেন, ‘কোভিড-১৯ অভিবাসীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে নতুন নতুন চ্যালেজ্ঞ নিয়ে হাজির হচ্ছে। এই মহামারী কিশোর-কিশোরীসহ, নারী-পুরুষ এবং শিশুদের ওপর বিভিন্নভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মানবপাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবাইকে হাতে হাত রেখে এক হয়ে কাজ করতে হবে।’
ওয়েবিনারে বক্তারা বলেন, ‘কর্মসংস্থান হ্রাস, আয় হ্রাস, জীবিকা নির্বাহের সীমিত উপায় এবং দেশব্যাপী স্কুল বন্ধের ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যা মানবপাচারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে। মানবপাচারের মূল কারণগুলো তীব্র হওয়ার পাশাপাশি, আশঙ্কা করা হচ্ছে যে বাংলাদেশে অপব্যবহার এবং শোষণ বাড়ছে। সম্প্রতি পর্যবেক্ষণ করা প্রবণতা এবং মিডিয়া শিরোনামগুলোর ওপর নজর দিলে দেখা যায় যে, পাচারকারীরা মানবপাচারের সম্ভাব্য শিকারদের প্রলুব্ধ করতে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যেমন টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি ব্যবহার করছে।’
বাংলাদেশে জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক নেটওয়ার্ক- বিডিইউএনএনএম এর সমন্বয়ক এবং আইওএম বাংলাদেশ-এর মিশন প্রধান গিওরগি গিগাওরি বলেন, ‘মানবপাচার হলো এমন একটি অপরাধ যা অভিবাসী শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, হয়রানি, জোরপূর্বক শ্রম, জোর করে এবং অবৈধ বিবাহ, অবৈধ বাণিজ্য এবং জীবন হারানোর মত ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। এটি বন্ধ করতে সরকার, উন্নয়ন অংশীদার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো, সুশীল সমাজ, বেসরকারি খাত এবং এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ব্যবস্থা নিতে হবে।’
জাতিসংঘে মানবপাচার বিষয়ক বিশেষ র্যাপোটিয়ার সিউবহান মুলালি তার বক্তব্যে বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর প্রভাব মানব পাচারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। শিশুপাচার বৃদ্ধির ঝুঁকি মোকাবিলা, অনলাইননে শোষণ, অভিবাসী কর্মীদের শোষণ এবং যৌন শোষণের বিশেষ ঝুঁকির বিরুদ্ধে খুব দ্রুত ভূমিকা নিতে হবে। মানবপাচার প্রতিরোধে ‘গ্লোবাল কমপ্যাক্ট ফর মাইগ্রেশন’ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ প্রতিশ্রুতি অবশ্যই সরেজমিনে অর্থবহ করতে হবে। এক্ষেত্রে কার্যকারী উদ্যোগ খুবই প্রয়োজন যাতে করে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো সঠিকভাবে পালন করে।’
জানা গেছে, বাংলাদেশ ইউনাইটেড নেশনস নেটওয়ার্ক অন মাইগ্রেশনের অধীনে কাউন্টার ট্রাফিকিং ইন পার্সন টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ (সিটিআইপিটিডব্লিউজি) এই ওয়েবিনারটির আয়োজন করে। যাতে সহযোগিতা করেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত এবং ইউএনওডিসি ও আইওএম কর্তৃক বাস্তাবায়িত গ্লো-অ্যাকট বাংলাদেশ প্রকল্প।
সারাবাংলা/জেআইএল/একে