Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চাইলেই নতুন করে ছাপা যাবে না আহমদ ছফার বই

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৩০ জুলাই ২০২১ ০০:২০

ঢাকা: র‌য়্যালিটি ও কপিরাইট ইস্যু নিয়ে বিরোধ তৈরি হওয়ায় দেশের সব প্রকাশনীকে আপাতত আহমদ ছফার বই প্রকাশ না করতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস। জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি ও হাওলাদার প্রকাশনীকে বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) এ সংক্রান্ত চিঠি দেওয়া হয়েছে। আহমদ ছফার বই প্রকাশ ও বিপণন করে এমন অন্যান্য প্রকাশনীকেও পর্যায়ক্রমে কপিরাইট অফিস থেকে চিঠি দেওয়া হবে।

বিজ্ঞাপন

কপিরাইট অফিস জানিয়েছে— নতুনভাবে আহমদ ছফার বই প্রকাশ করতে হলে নিরপেক্ষ কমিটির অনুমতি লাগবে। আহমদ ছফা জীবিতকালে কোনো রচনার কপিরাইট নিবন্ধন করেননি কিংবা তিনি কাউকে কপিরাইট দিয়ে যাননি। সম্প্রতি আহমদ ছফার রচনাবলীর সম্পাদক নূরুল আনোয়ার ও হাওলাদার প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মো. মাকসুদের মধ্যে কপিরাইট ইস্যুতে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এ নিয়ে কপিরাইট অফিসে অভিযোগও জমা হয়। একপর্যায়ে তা আপিল পর্যন্ত গড়ায়।

বিজ্ঞাপন

আপিলে মো. মাকসুদের দাবি খারিজ হয়ে যায়। পাশাপাশি আহমদ ছফার বই প্রকাশ করতে নিরপেক্ষ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয় রায়ে। আহমদ ছফার প্রতি গভীর অনুরাগী ও সমাজে গ্রহণযোগ্যতা আছে এমন ব্যক্তিকে নিরপেক্ষ কমিটির প্রধান হিসেবে রাখার প্রস্তাব আসে।

কপিরাইট নিবন্ধক জাফর রাজা চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘রায়ে আহমদ ছফার বই প্রকাশের বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সলিমুল্লাহ খান কিংবা কবি নূরুল হুদাকে কমিটির নেতৃত্বে রাখার চিন্তা-ভাবনা ছিল। এছাড়া কপিরাইট ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রামের চন্দনাইশের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, নূরুল আনোয়ার কিংবা আহমদ ছফার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে নিয়ে এ কমিটি গঠন করা যেতে পারে বলে মত দেওয়া হয়। শিগগিরই কমিটি গঠন করা হবে। কমিটির অনুমতি ছাড়া আপাতত কোনো প্রকাশনী আহমদ ছফার বই প্রকাশ করতে পারবে না।’

জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, ‘যে সব প্রতিষ্ঠান এরইমধ্যে বই প্রকাশ করেছেন চুক্তি মোতাবেক তাদের কাছে কত কপি বই আছে তার তালিকা ১৬ আগস্টের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়েছে। চুক্তির সঙ্গে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ঠিক আছে কি না তা যাচাই-বাছাই করা হবে। এরপর নিরপেক্ষ কমিটির অনুমতি নিয়ে ভবিষ্যতে বই প্রকাশ করতে হবে। বই প্রকাশের শর্তাবলি নিরপেক্ষ কমিটি নির্ধারণ করে দেবে। কমিটির অনুমতি ছাড়া কোনো প্রকাশনী পরবর্তীতে বই প্রকাশ করলে কপিরাইট আইন অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

নিরপেক্ষ কমিটির কাজ হবে প্রকাশক নির্বাচন ও রচনা প্রকাশের অনুমতিসংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদন;  রয়্যালটির হার নির্ধারণ ও প্রকাশকের কাছ থেকে তা সংগ্রহ; প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তদারকি এবং প্রাপ্ত রয়্যালটি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে প্রাপ্যতা অনুযায়ী বণ্টন। এ ছাড়া মরহুম আহমদ ছফার স্মৃতি ও রচিত গ্রন্থাবলি সংরক্ষণের উদ্দেশে আহমদ ছফা ট্রাস্ট গঠনের কথাও বলে কপিরাইট অফিস।

কপিরাইট নিবন্ধক জাফর রাজা চৌধুরী জানান, কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হয়েছেন। এমন অবস্থায় তিনি কমিটিতে থাকতে পারবেন কি না জানতে চেয়ে আমরা তাকে চিঠি দেব। এ ছাড়া কমিটির দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে ড. সলিমুল্লাহ খানের অবস্থান জানতে আমরা চিঠি দিয়েছি। চিঠিতে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো জবাব না দিলে বিকল্প কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের অনুসন্ধান করা হবে।

উল্লেখ্য, সন্দেশ, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, মাওলা ব্রাদার্স, হাওলাদার প্রকাশনী, বাঁধন পাবলিকেশন্স, স্টুডেন্ট ওয়েজ আহমদ ছফার বই প্রকাশ ও বিতরণ করে আসছে। নিরপেক্ষ কমিটির কার্যক্রম শুরু হলে কোনো প্রকাশনীই কমিটির অনুমতি ছাড়া বই প্রকাশ করতে পারবে না।

এর আগে, গত বছরের ২৪ মার্চ ‘লেখক আহমদ ছফা রচনাবলির কপিরাইট : নূরুল আনোয়ার বনাম মো. মাকসুদ, স্বত্বাধিকারী হাওলাদার প্রকাশনী’র অভিযোগের রায় ঘোষণা করেন কপিরাইট নিবন্ধক। ওই আদেশে মাকসুদকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

আদেশে অসন্তুষ্ট হয়ে মো. মাকসুদ ওই বছরের ২০ জুলাই কপিরাইট বোর্ডে আপিল দায়ের করেন। গত ৪ এপ্রিল আপিলের নিষ্পত্তি করা হয়। আপিল নম্বর: ৫২/২০২০

কপিরাইট অফিসে যা বলেন নূরুল আনোয়ার: আহমদ ছফা চিরকুমার থাকা অবস্থায় ২০০১ সালের ২৮ জুলাই মারা যান। ব্যক্তিগত সম্পর্কে তিনি আহমদ ছফার ভ্রাতুষ্পুত্র (সৎভাইয়ের ছেলে)। আহমদ ছফা তাকে কাছে রেখে লালনপালন করেন। চাচার (ছফা) কাছে থেকেই তিনি পড়াশোনা ও লেখালেখির দীক্ষা নেন। মৃত্যুর দিনও তিনি আহমদ ছফার শয্যাপাশে ছিলেন। আহমদ ছফার পরিবারে সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা এবং তার বইগুলো দেখাশোনা করার মতো কোনো যোগ্য লোক আর কেউ ছিলেন না। ফলে তাঁর রচিত সব বইয়ের স্বত্বাধিকার লিখিতভাবে তিনি (ছফা) তাকে প্রদান করেন।

শুনানিতে নূরুল আনোয়ার বলেন, কেবল আহমদ ছফা নয়, তার আপন বোন বিলকিছ খাতুনও ২০০৭ সালে তাকে (নূরুল আনোয়ার) সব বইয়ের স্বত্বাধিকার দিয়ে যান। পরে তিনি মারা যান। বিলকিছ খাতুনের এক পুত্রসন্তান ছিলেন। তিনিও পরে মারা যান। তাঁরা জীবিত থাকা অবস্থায় কখনো স্বত্বাধিকার দাবি করেননি। কারণ, তারা জানতেন তাকে বৈধভাবে স্বত্বাধিকার দেওয়া হয়েছে।

শুনানিতে নূরুল আনোয়ার উল্লেখ করেন, আহমদ ছফার সব লেখা নিয়ে বর্তমানে নয় খণ্ড রচনাবলি তার সম্পাদনায় প্রকাশিত। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক লেখা তার সংগৃহীত ও সম্পাদিত। ২০০৮ ও ২০১১ সালে খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি বইগুলো প্রকাশ করে এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন খণ্ড পুনর্মুদ্রণ ও বাজারজাত হয়। বর্তমানেও বইগুলো বাজারে আছে।

নূরুল আনোয়ার উল্লেখ করেন, প্রতিটি খণ্ডেই তার লেখা ভূমিকা, প্রবন্ধ ও পাদটীকা যুক্ত আছে। একটি খণ্ডে একটি মুদ্রণপ্রমাদ রয়ে যায়। কিন্তু ২০১৪ সালে হাওলাদার প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মো. মাকসুদ তার লেখা ভূমিকা, প্রবন্ধ ও পাদটীকাসহ এই বইগুলো হুবহু প্রকাশ করেন।

জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, ‘আহমদ ছফা নূরুল আনোয়ারকে গ্রন্থস্বত্ব দিয়ে গেছেন এরকম দাবি প্রমাণ হয়নি। তাই আহমদ ছফার বইগুলোর গ্রন্থস্বত্ব তার একক বিষয় নয়।’

তিনি বলেন, ‘আহমদ ছফার বইয়ে নূরুল আনোয়ারের লেখা ভূমিকা, পাদটীকা মো. মাকসুদ তার প্রকাশিত খণ্ডে হুবহু প্রকাশ করেন। মাকসুদের বিরুদ্ধে কপিরাইট আইনের ৭১ ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এ কারণে মো. মাকসুদের অনুকূলে দেওয়া আহমদ ছফার রচিত ১০টি গ্রন্থের কপিরাইট সনদ বাতিলের জন্য কপিরাইট বোর্ডের কাছে পাঠানো হয়েছে।’

গত ৪ এপ্রিল কপিরাইট বোর্ডের চেয়ারম্যান সাবিহা পারভীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় মো. মাকসুদের আপিল আবেদন নামঞ্জুর করা হয়।

আহমদ ছফার ভাতিজা ও লেখক নূরুল আনোয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আহমদ ছফার মৃত্যুর পর তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলো এক জায়গায় করে সম্পাদনার মতো কঠিন কাজটি আমি করেছি। এ সময় বৈষয়িক কোনো স্বার্থের কথা চিন্তা করিনি। দিন-রাত পরিশ্রম করে আহমদ ছফার রচনাবলির ৯টি খণ্ড আমি সম্পাদনা করেছি। এ কাজগুলো করতে গিয়ে কারও কারও বিরাগভাজন হয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি আহমদ ছফার জন্য কী করেছি, কতটুকু করেছি তা সময় বলে দেবে। আহমদ ছফা ইস্যুতে যা কিছু ভালো—তার প্রতি সবসময় আমার পূর্ণ সমর্থন থাকবে। এর বেশি কিছু আপাতত বলতে চাই না।’

হাওলাদার প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মো. মাকসুদ বলেন, ‘নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে আহমদ ছফার বইগুলো প্রকাশ হলে একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি হবে। এটি ভালো একটি কাজ হবে বলে মনে করি। আমিও চাই কমিটিতে যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য মানুষ আসুক।’

তিনি আরও বলেন, ‘কপিরাইট অফিস থেকে চিঠি পেয়েছি। চিঠির জবাব দেব। আপিল করার সময়ও কপিরাইট অফিসে বইয়ের হিসাব দিয়েছিলাম। নতুন করে আবার হিসাব চেয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হিসাব দিয়ে দেব।’

সারাবাংলা/একে

আহমদ ছফা কপিরােইট অফিস প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর