অনুমতি ছাড়াই চলছে করোনা চিকিৎসা, তথ্য যাচ্ছে না সরকারি তালিকায়
৩১ জুলাই ২০২১ ০৯:০১
ঢাকা: রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত রেডিকেল হাসপাতাল। এ বছরের এপ্রিলে কোভিড-১৯ সংক্রমণ মাত্রা ছাড়ালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমতি না নিয়েই হাসপাতালটি কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের চিকিৎসা দিতে শুরু করে। সেই এপ্রিল এ বছরের জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন করোনা আক্রান্তদের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জন মারা গেছেন। চলতি জুলাই মাসের প্রথম ২০ দিনেই হাসপাতালটিতে কোভিড-১৯ সংক্রমিত ব্যক্তি মারা গেছেন ৯ জন। তবে তাদের একজনের তথ্যও যোগ হয়নি স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকায়।
একই পরিস্থিতি উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের শিনশিন জাপান হাসপাতালেও। এই হাসপাতালটিও অনুমোদন ছাড়াই কোভিড পজিটিভ রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, রোগীদেরও না জানিয়ে একই ফ্লোরে নন-কোভিড রোগীদের পাশাপাশি কোভিড রোগীদেরও চিকিৎসা চলছে এই হাসপাতালে। গত দেড় মাসে এই হাসপাতালে মারা গেছেন এমন ২০ জনেরও বেশি কোভিড সংক্রমিত রোগী। সে তথ্যও যুক্ত হয়নি স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকায়।
উত্তরাতেই ১৪ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত আল আশরাফ হাসপাতালেও কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আগের দুই হাসপাতালের মতো কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার অনুমোদন নেই তাদেরও। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, গত তিন মাসে করোনা পজিটিভ ১৯ জন রোগী এখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর পায়নি সে তথ্যও।
উত্তরার এই তিনটি হাসপাতালই কেবল নয়— মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলী, শ্যামলী, আদাবর, সায়েদাবাদ, ওয়ারি, নারিন্দা, ধানমন্ডি, গ্রিন রোড, শেরে বাংলা নগরসহ রাজধানীজুড়েই এমন বিপুলসংখ্যক বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এসব হাসপাতালের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনার অভিযোগ, বেশিরভাগ হাসপাতালেই নেই করোনা চিকিৎসার পর্যাপ্ত প্রস্তুতিও। ফলে চিকিৎসার চেয়েও বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রোগীর স্বজনদের। রয়েছে অতিরিক্ত বিল আদায়ের অভিযোগ, এমনকি করোনা চিকিৎসায় জাতীয় গাইডলাইন অনুসরণ না করার অভিযোগও রয়েছে অনেক বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুমতি ছাড়াই করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া এবং চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনা তো রয়েছেই, তবে এসব বেসরকারি হাসপাতাল ঘিরে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো— তাদের কোনো তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে যুক্ত হয় না। হাসপাতালগুলোই স্বীকার করে নিচ্ছে, করোনা চিকিৎসার অনুমতি না থাকার কারণেই তাদের কাছে আসা রোগীদের সংক্রমণ ও মৃত্যুর কোনো তথ্যই বাইরে প্রকাশ হয় না। ফলে আরটি-পিসিআর বা অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় কোভিড পজিটিভ হয়ে এসব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত ব্যক্তিদের তথ্য জাতীয় তথ্যভাণ্ডারে নেই। ফলে স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত, মৃত বা সুস্থ ব্যক্তিদের যে পরিসংখ্যান প্রতিদিন প্রকাশ করে থাকে, সেটি অসম্পূর্ণ! আর এমন হাসপাতাল সংখ্যাই অনেক বেশি বলেই বিষয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, রাজধানীতে বর্তমানে হালনাগাদ লাইসেন্সধারী বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ৪৭৭টি। এর মধ্যে মাত্র ২৮টির করোনা চিকিৎসা দেওয়ার অনুমতি আছে। অর্থাৎ কেবল এই ২৮টি হাসপাতালের করোনা রোগীদের তথ্যই যুক্ত হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সেন্টারে (এমআইএস)। বাকি ৪৪৯টি, অর্থাৎ মোট বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের ৯৪ শতাংশের তথ্যই যোগ হয় না এই তালিকায়। অথচ এই প্রায় সাড়ে চারশ হাসপাতালের বেশিরভাগই উত্তরার রেডিকেল, শিনশিন ও আল আশরাফের মতো করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে। সেখানেও প্রতিনিয়তই মারা যাচ্ছে করোনা আক্রান্ত রোগী, কেউ কেউ সুস্থ হয়ে ফিরছেন ঘরে। এর কোনো হিসাবই আসছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রকাশিত কোভিড সংক্রান্ত নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে।
উত্তরার ওই তিনটি হাসপাতালসহ রাজধানীর কমপক্ষে ১৭টি হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে সারাবাংলার, যারা কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে চলেছে। হাসপাতালগুলোর সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, করোনা চিকিৎসার জন্য আবেদন করলে অনেকেই হয়তো অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকায় অনুমতি পাবে না। এমন আশঙ্কায় আবেদন করছে না অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। কেউ কেউ আবেদন করে রাখলেও অধিদফতরের সঙ্গে তথ্য শেয়ার করার পদ্ধতি জানে না। আবেদন করলেও সে আবেদনের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি— এমনটিও বলছেন কেউ কেউ। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছে, রাজধানীর বেসরকারি সব হাসপাতালের চিত্রই মূলত একই রকম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার অনুমতি না থাকায় রোগীদের সঙ্গে বিশেষ কৌশল করে থাকে হাসপাতালগুলো। এসব হাসপাতালে ভর্তির সময়ই স্বজনদের বলে রাখা হয় পিসিআর পজিটিভ রিপোর্ট না দেওয়ার জন্য। সাংবাদিকসহ বাইরের কেউ জিজ্ঞাসা করলে ‘নমুনা পরীক্ষা এখনো করা হয়নি’ বলতে বলা হয়। এই প্রতিবেদকও একাধিক হাসপাতালে হাজির হলে একই বক্তব্য জানানো হয়। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব ‘উপসর্গযুক্ত’ রোগীদের প্রায় সবাই কোভিড-১৯ পজিটিভ। যাদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়নি, হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় নমুনা পরীক্ষা করে কোভিড পজিটিভ এলে চিকিৎসা দিতে পারবে কি না— এমন আশঙ্কা থেকে নমুনা পরীক্ষাও করানো হয় না তাদের।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, প্রতিনিয়ত সবাইকে কোভিড-১৯ চিকিৎসা বিষয়ে জানানো হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও বলা হয়েছে অনুমতি নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। তাদের কছে দফায় দফায় করোনা রোগীদের তথ্য চাওয়া হলেও হাসপাতালগুলো লুকোচুরি করছে। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময় অভিযান চালানো হলে কয়েকদিন সবাই নিয়ম মেনে চললেও পরে ফের আগের মতো হয়ে যায় বলে অভিযোগ অধিদফতরের।
উত্তরার রেডিকেল হাসপাতালকেই যেমন বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসা বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল বলে জানায় অধিদফতর। তবে কিছুদিন বন্ধ রেখে এটি ফের আগর মতো চলছে। আল আশরাফ হাসপাতাল নিয়ে অধিদফতরের বক্তব্য, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতালটি অনুমোদন ছাড়াই করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে সব হাসপাতালকেই তথ্য দিতে বলা হয়। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় তারা সেটি দিচ্ছে না। আমার বিভিন্ন উপজেলা থেকে কিন্তু তথ্য চলে আসছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকেও তথ্য পেলে সেটি প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝাতে সাহায্য করত।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা সারাবাংলাকে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টাতেও আমরা বেশ কয়েকটি হাসপাতালে কথা বলেছি। দেশের এই দুর্যোগ মুহূর্তে সবারই এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এ অবস্থায় যারা করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দিচ্ছে, তারা অনুমোদন নিয়ে চিকিৎসা দিলে তথ্য আদান-প্রদানে সুবিধা হয়, স্বচ্ছতাও থাকে।
তিনি বলেন, সরকার জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে বদ্ধ পরিকর। তবে কোনো ধরনের অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। সরকারিভাবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে চিকিৎসা দিয়ে যাওয়ার জন্য। একইভাবে বেসরকারি হাসপাতালেও গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে। তারপরও অভিযোগ আসে। সেগুলো দূর করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা কোভিড-১৯ চিকিৎসার মান ও ব্যয় সংক্রান্ত নানা বিষয় তদারকি ও নজরদারি করবে। এই কমিটিগুলো হাসপাতাল পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। তাদের সেই সুপারিশের ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সেন্টার (এমআইএস) বিভাগের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে প্রতিদিনই হাসপাতালগুলোকে ফোন করা হয়। তাদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়। কিন্তু সেটি যদি তারা না পাঠায়, সেটি দুঃখজনক। তবে এটি করে পার পাওয়া যাবে না। তথ্য না পাঠালে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা সামনে সবাই জানতে পারবে।
মহামারি মোকাবিলায় চিকিৎসাব্যবস্থা সম্প্রসারিত করা ও যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি তথ্যেরও বড় ভূমিকা রয়েছে— মন্তব্য অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমানের।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর