রানা প্লাজা ধস: করোনায় ঝুলে আছে ৩ মামলার বিচার
২ আগস্ট ২০২১ ১৩:০২
ঢাকা: ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে নয়তলা ভবন রানা প্লাজা ধসে পড়লে ১ হাজার ১৩৬ জন মারা যান। আহত ও পঙ্গু হন প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সাভার থানার ভবন নির্মাণে অবহেলা ত্রুটিজনিত হত্যাসহ চারটি মামলা দায়ের করা হয়।
ঘটনার ৮ বছর পার হলেও এখনও তিন মামলার বিচার শেষ হয়নি। সম্প্রতি করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জানিয়েছে পরিবেশ স্বাভাবিক হলে খুব দ্রুত মামলাগুলোর বিচার শেষ করতে পারবেন আদালত।
ভবন ধসে বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় ওই সময় মোট চারটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে অবহেলার কারণে মৃত্যু উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ, ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় একটি মামলা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং ভবন নির্মাণে দুর্নীতি ও সম্পদের তথ্য গোপন সংক্রান্ত দু’টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের দায়ের করা সম্পদের তথ্য গোপনের মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে। এর বাইরে ভবন নির্মাণে দুর্নীতির মামলাটিও বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে আদালত সুত্রে জানা গেছে। বাকি দুটি মামলার কার্যক্রমই থমকে রয়েছে। মামলা দুটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু আসামিদের করা অবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারছেন না বিচারিক আদালত।
২০১৬ সালে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা ও ইমারত আইনের মামলা দুটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হয়। একই বছরের ১৫ মার্চ মামলা দু’টি বিচার ও নিষ্পত্তির জন্য ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এবং বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। ওই বছরের ১৬ জুন ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম মুস্তাফিজুর রহমান। এরপর ১৮ জুলাই হত্যা মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন তৎকালীন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান।
তবে অভিযোগ গঠনের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আট আসামি হাইকোর্টে আবেদন করেন। শুনানি শেষে প্রথমে আট জনের পক্ষেই স্থগিতাদেশ দেন আদালত। পরে ছয় জনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বহাল থাকে সাভার পৌরসভার ওই সময়কার মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানের পক্ষের স্থগিতাদেশ।
বর্তমানে রানা প্লাজা হত্যা মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য রয়েছে। কিন্তু আসামি মোহাম্মাদ আলী খান ও রেফায়েত উল্লাহর পক্ষে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকায় মামলার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না।
২০১৫ সালের ১ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের আলাদা দুই মামলায় ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
ইমারত নির্মাণ আইনের অভিযুক্ত আসামিরা হলেন, ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার মেয়র রেফায়েত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামাল, আমিনুল ইসলাম, নিউওয়েব স্টাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইথার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলম, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাকটার এবং রেজাউল ইসলাম।
দুই মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আবদুল খালেক ওরফে খালেক কুলুসহ ৫৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে আসামিদের মধ্যে ১৭ জনের নাম উভয় মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ থাকায় ব্যক্তি হিসেবে আসামি ৪২ জন। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ৪১ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং সাক্ষী করা হয়েছে ৫৯৪ জনকে। ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ১৮ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং সাক্ষী করা হয়েছে ১৩৫ জনকে।
অন্যদিকে নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৫ জুন সাভার থানায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে দুদক। মামলাটি চার্জশিটে ১২ আসামির কথা উল্লেখ করা হয়। সোহেল রানা ছাড়া অন্য ১১ জনই এখন জামিনে আছেন। এ মামলাটি বর্তমানে অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মারুফ চৌধুরীর আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী ২৬ এপ্রিল উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ মেয়াদ বৃদ্ধিকরণ বিষয়ে আদেশ দাখিলের জন্য তারিখ ধার্য ছিলো। তবে করোনাভাইরাসের কারণে কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট আদালতের এডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আনোয়ারুল কবীর জানান, মামলাটি দুইটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে এসে থমকে রয়েছে। আসামিপক্ষ স্থগিতাদেশ না যাওয়া পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। এটা সম্পূর্ণ উচ্চ আদালতের বিষয়। আমাদের কাছে নির্দেশ আসামাত্র সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করব। এটি বর্তমানে অ্যাটর্নি জেনারেলের বিষয়। তিনি চাইলে এটি ভ্যাকেটং করলে পুনরায় কার্যক্রম শুরু হতে পারে।
তবে করোনাভাইরাস ও উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশের জন্য মামলাটি দুইটি বিচার একটু বিলম্ব হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘করোনাভাইরাস স্বাভাবিক ও স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে পূনরায় মামলাটির বিচারকার্য শুরু করতে পারব।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ জানায়, ঘটনার ৪ দিন পরে রানা আটক হয়। বিনা বিচারে আজ ৮ বছর ধরে জেলে রয়েছে। অন্যান্য মামলাগুতে জামিন হয়ে গেছে। তবে হত্যা মামলাটিতে জামিন হয়নি। এটিতে জামিন হলে বের হতে পারবেন রানা। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যরা বাইরে আছেন।
তিনি আরও বলেন, রানার বিরুদ্ধে মোট ৫ টি মামলা হয়েছে। ১ নিষ্পত্তি হয়েছে, সেটার সাজাও শেষ হয়ে গেছে। বাকিগুলো করোনাভাইরাস ও স্থগিতাদেশ জন্য আটকিয়ে রয়েছে। এতোদিন জেলে রয়েছে তার জামিন পাওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলাটিই কেবল নিষ্পত্তি হয়েছে। এ মামলায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ঢাকার বিশেষ জজ-৬-এর বিচারক।
সারাবাংলা/এআই/একে