৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে চায় বাম গণতান্ত্রিক জোট
৬ আগস্ট ২০২১ ১০:০৮
আবদুল্লাহ আল ক্বাফী। কাফি রতন নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রেসিডিয়াম সদস্য। বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন একসময়। সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বিএসএস ও এমএসএস ডিগ্রি নিয়েছেন। পরে ১৯৮৮ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোর হায়ার কমসোমোল স্কুল থেকে সামাজিক বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিপ্লোমা নেন। ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সভাপতি ছিলেন। ডাকসুর হল সংসদের সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন। সক্রিয় ছিলেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও। বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের দুই মেয়াদের সভাপতি। বর্তমানে সিপিবি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য ছাড়াও বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন।
চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিসহ দেশের রাজনীতি এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন সারাবাংলা ডটনেটের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সারাবাংলার স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আজমল হক হেলাল। কথোপকথনের চুম্বক অংশ থাকছে সারাবাংলার পাঠকদের জন্য—
সারাবাংলা: করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারি পদক্ষেপগুলোকে কীভাবে দেখছেন? করোনা মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতা ও সফলতা সম্পর্কে মন্তব্য কী?
কাফি রতন: সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সিপিবি ও বাম গণতান্ত্রিক জোট ২০২০ সালের মার্চ থেকে করোনা প্রতিরোধে যেসব পদক্ষেপ নিতে বলেছে, তার কিছুই সরকার নেয়নি বা বাস্তবায়ন করেনি। বলা হয়েছিল, জেলায় জেলায় করোনা পরীক্ষার জন্য আরটি-পিসিআর ল্যাব করার কথা। কিন্তু এ মুহূর্তে দেশে মাত্র ৩৭ জেলায় পিসিআর ল্যাব রয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়ন-উপজেলায় নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র করার দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু এখনো তা কার্যকর করা হয়নি। আইসিইউ বেড ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির বিষয়টিকেও সরকার উপেক্ষা করেছে। করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে সরকারের দোদুল্যমান অবস্থা সবাই দেখেছে। সরকারের ভেতরেও সরকার রয়েছে। তাদের কারণে ভারত থেকে আমদানি করা প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনে বেক্সিমকোকে এক ডলার মুনাফা দিতে হয়েছে।
সরকার তার নীতির প্রতিও একনিষ্ঠ থাকতে পারছে না। সরকার কোনোবারই ঘোষিত লকডাউন পরিপূর্ণভাবে পালন করতে পারেনি। লুটেরা ধনিকগোষ্ঠীর স্বার্থের কাছে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। সরকারের মধ্যের সরকারের লুটপাটের কারণে প্রায় দুই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। ৭৭ শতাংশ মানুষের আয় সংকুচিত হয়েছে। কিন্তু, ঠিকই হাজার হাজার নতুন কোটিপতি হয়েছে। এটা কী করে সম্ভব হলো? এটা সম্ভব হয়েছে সরকারের এক দেশ দুই নীতির কারণে।
সারাবাংলা: করোনা মহামারির এই সময়ে বাম ধারার রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের পাশে খুব একটা দাঁড়াতে দেখা যায়নি। অভিযোগ রয়েছে— এসব দল বিবৃতি দেওয়া, সরকারের সমালোচনা ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ ব্যাপারে আপনি কী মন্তব্য করবেন?
কাফি রতন: এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। অন্য দলের দায়িত্ব না নিয়ে নিজের দল সিপিবি’র কথা বলতে পারি। প্রতিটি জেলা কমিটি, প্রতিটি গণসংগঠন এই মহামারির সময়ে তাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়েও জনগণের পাশে রয়েছে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানিয়ে বিলি করা-রান্না করে প্যাকেট খাবার দেওয়া; চাল, ডাল, তেলসহ খাদ্য সামগ্রী বিলি করা; কৃষকের ধান কেটে দেওয়া; গ্রাম-মহল্লা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা; অক্সিজেন সিলিন্ডার ঘরে পৌছে দেওয়া; করোনা ভ্যাকসিনের জন্য রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়া— সব ধরনের কাজ কমরেডরা করেছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক— ক্ষমতা নেই বলে হাতে রিসোর্স নেই। কিন্তু জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করে যাদের প্রয়োজন তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। করোনা সংকট যেমন বৈশ্বিক, তেমনি জাতীয়। বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সব দলকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয়ভাবে এ সংকট মোকাবিলার আবেদন জানানো হয়েছিল। তারা কর্ণপাত করেনি। বরং আওয়ামী লীগ করোনার চেয়ে শক্তিশালী দাবি করে একলা চলো নীতি নিয়েছে। আমরা এ সময়ে করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি সরকারের গণবিরোধী নীতি নিয়ে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যেও রাজপথে সোচ্চার ছিলাম।
সারাবাংলা: সরকার দেশের উন্নয়নের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার পাশাপাশি মহামারি করোনা মোকাবিলায় প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে বলে সরকার দলীয় নেতাদের দাবি। এ দাবির সঙ্গে কি আপনি একমত? একমত না হলে দ্বিমত কেথায়?
কাফি রতন: করোনা অতিমারি মোকাবিলায় সরকার ব্যর্থ। সরকারি নীতি পদ্ধতির সাফল্যও সামান্যই। সরকারের লক্ষ্য বড় বড় প্রকল্প। বড় প্রকল্প মানে বড় দুর্নীতির সুযোগ। দেড় বছরের পত্রিকায় কেবল সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সংগঠিত অসংখ্য দুর্নীতির চমকপ্রদ সব কাহিনী ছাপা হয়েছে। দুর্নীতির সাফল্যে এ সরকার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন চাটার দল। আর শেখ হাসিনা নিজের দলের নেতাকর্মীদের সম্পর্কে বলেছেন, তিনি কাফনের কাপড় দিলেও ওরা তা দিয়ে পাঞ্জাবি বানিয়ে নেবে।
সারাবাংলা: সরকারি ভ্যাকসিন কার্যক্রম নিয়ে কী বলবেন?
কাফি রতন: ভ্যাকসিন কার্যক্রমের শুরুতে সরকারি দোদুল্যমান অবস্থার কারণে আমাদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম পিছিয়ে পড়েছে। এখনো অনেকে আছেন যারা প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন কিন্তু দ্বিতীয় ডোজ নিতে পারেননি। বর্তমানে এনআইডি কার্ড দেখিয়ে যে ভ্যাকসিন দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা জরুরি।
সারাবাংলা: বাম গণতান্ত্রিক জোট সুষ্ঠু ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি করে আসছে। দাবি বাস্তবায়নে আপনাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও তৎপরতা দৃশ্যমান নয়। এখন অবশ্য করোনা মহামারির কারণে স্বাভাবিকভাবেই হাত গুটিয়ে থাকতে হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আপনারা কী পদক্ষেপ নেবেন?
কাফি রতন: ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের ভোট ডাকাতির নির্বাচনের পরে বামজোট ২০১৯ সালের ১১ জানুযারি গণশুনানি করে। সেখান থেকে অবৈধ এ সরকারের পদত্যাগ ও তদারকি সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন দাবি জানায়। এ সরকার যত দ্রুত ক্ষমতা ছাড়বে, জাতির জন্য সেটি তত কল্যাণকর হবে। এটা ঠিক, করোনা মহামারির জন্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়েছে। তবে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সংগ্রাম জারি রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সরকার পতনের দাবিতে বাম জোটের উদ্যোগে রাজপথে লড়াই আরও জোরদার হবে।
সারাবাংলা: নির্বাচন নিয়ে আপনাদের প্রস্তুতি কেমন? ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে পারবেন?
কাফি রতন: কমরেডরা লড়াইয়ের মাঠে রয়েছে। আমরা নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করি না। জনগণের দৈনন্দিন সংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি। তবে পরিবেশ থাকলে অবশ্যই নির্বাচন করবে বাম জোট। ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
সারাবাংলা: বাম গণতান্ত্রিক জোটের পরিধি কি আরও বাড়বে?
কাফি রতন: আট দল নিয়ে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে বাম গণতান্ত্রিক জোট যাত্রা শুরু করেছিল। ২০২০ সালে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির যোগ দেওয়ায় জোট সম্প্রসারিত হয়েছে। ভবিষ্যতে জোট আরও সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। অন্যান্য ক্রিয়াশীল বামপন্থী জোটগুলোর সঙ্গে আরও নৈকট্য তৈরির সব সম্ভাবনা রয়েছে।
সারাবাংলা: গুঞ্জন আছে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ভেতরে একটি অংশ সরকারের অর্থাৎ আওয়ামী লীগের পারপাস সার্ভ করছে এবং আরেকটি গ্রুপ বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায়। এই গুঞ্জন কতটুকু সত্য?
কাফি রতন: কোনো গুঞ্জনে কান দেওয়া ঠিক না। আমরা ক্ষমতাসীন শ্রেণিকে উচ্ছেদ করে শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে চাই। আমাদের এ পথে যারা বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাদের চূর্ণ-বিচূর্ণ করে এগিয়ে যাওয়াটাই আমাদের কর্তব্য। আমরা সে কর্তব্য সম্পাদনে অবিচল আছি।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/একেএম/টিআর