১৭ মাসে সংক্রমণ ছাড়াল ১৩ লাখ, শেষ ৫ লাখ ২ মাসে
৫ আগস্ট ২০২১ ১২:৩১
ঢাকা: দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার প্রায় ১৭ মাস, সুনির্দিষ্টভাবে বললে ৫১৫তম দিনে এসে সংক্রমণ ছাড়িয়েছে ১৩ লাখ। এর শেষ অর্ধেক, অর্থাৎ শেষ সাড়ে ছয় লাখ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে গত ১১৯ দিন বা প্রায় চার মাসে। অন্যদিকে, মোট সংক্রমণের মধ্যে সবশেষ পাঁচ লাখ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে মাত্র দুই মাসে! করোনা সংক্রমণের এ ঊর্ধ্বগতির মধ্যে শেষ এক লাখ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে আট দিনে।
বুধবার (৪ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৪৯ হাজার ৫১৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৩ হাজার ৮১৭ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত দেশে ৭৯ লাখ ৪৮ হাজার ৬৮৩টি নমুনা পরীক্ষায় সংক্রমণ শনাক্ত হলো ১৩ লাখ ৯ হাজার ৯১০ জনের মাঝে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ১১৯ দিন বা চার মাসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ছয় লাখ ৫০ হাজার ৬৩২টি। অন্যদিকে, শেষ ৬০ দিন বা দুই মাসেই সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে পাঁচ লাখ ৫৯৬টি। অর্থাৎ, দেশে করোনার উপস্থিতি শনাক্ত হওয়ার পর প্রথম ১৩ মাসে যে পরিমাণ সংক্রমণ পাওয়া গেছে, এর সমান সংক্রমণ পাওয়া গেছে শেষ চার মাসে!
আবার প্রথম পাঁচ লাখ সংক্রমণ শনাক্ত হতে যেখানে সময় লেগেছিল ২৮৮ দিন বা প্রায় ১০ মাস, সেখানে শেষ পাঁচ লাখ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে মাত্র ৬০ দিনে। অন্যদিকে, শেষ এক মাসে সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৫৫ হাজার ২৯টি। অথচ প্রথম তিন লাখ ৫৫ হাজার সংক্রমণ শনাক্ত হতে সময় লেগেছিল ২০১ দিন!
শেষ ৮ দিনে ১ লাখ সংক্রমণ
গত জুলাই থেকেই মূলত দেশে করোনা সংক্রমণের এই ধারা ব্যাপকভাবে ঊর্ধ্বমুখী। জুলাইয়ের আগে যেখানে দেশে একদিনে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল সর্বোচ্চ সাড়ে সাত হাজারের কিছু বেশি, সেখানে জুলাইয়ের শুরুটাই হয় ৮ হাজারের বেশি সংক্রমণ দিয়ে। এই সংক্রমণ ছাড়িয়েছে ১৬ হাজারের সীমাও। সেই ধারাবাহিকতায় রয়েছে আগস্টেও। আর সে কারণেই দেশে সবশেষ আট দিনে সংক্রমণ ছাড়িয়ে গেছে এক লাখ। এই আট দিনে মোট সংক্রমণ এক লাখ ১৫ হাজার ১৫৮। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ১৪ হাজার ৩৯৪টি!
মাস ভিত্তিতে কোভিড-১৯ সংক্রমণের
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে দেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করা হলেও প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় মার্চে। ওই মাসে মোট এক হাজার ৩১০টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫১ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণের হার ছিল ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
এপ্রিল মাসে দেশে ৬২ হাজার ৮২৬টি নমুনা পরীক্ষা করে সাত হাজার ৬১৬ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণের হার ছিল ১২ দশমিক ১২ শতাংশ।
মে মাসে দেশে দুই লাখ ৪৪ হাজার ২৬৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৩৯ ৪৮৬ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণের হার ছিল ১৬ দশমিক ১৭ শতাংশ।
জুন মাসে দেশে চার লাখ ৬০ হাজার ৫৩০টি নমুনা পরীক্ষা করে ৯৮ হাজার ৩৩০ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণের হার ছিল ২১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসের আগ পর্যন্ত এটিই এক মাসে সর্বোচ্চ সংক্রমণ।
এ বছরের জুলাইয়ে মোট চার লাখ ৭ হাজার ৩৪৯টি নমুনা পরীক্ষা করে ৯২ হাজার ১৭৮ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণের হার ছিল ২২ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
আগস্ট মাসে তিন লাখ ৭৩ হাজার ৩৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৭৫ হাজার ৩৩৫ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণের হার ছিল ২০ দশমিক ১৮ শতাংশ।
সেপ্টেম্বরে সংক্রমণ আরও কিছুটা কমে। তিন লাখ ৯৭ হাজার ৫৪৮টি নমুনা পরীক্ষা করে সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৫০ হাজার ৪৮৩টি। সংক্রমণের হার ছিল ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ।
অক্টোবর মাসে তিন লাখ ৮৮ হাজার ৬০৭টি নমুনা পরীক্ষায় ৪৪ হাজার ২০৫ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণের হার ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
নভেম্বর মাসে চার লাখ ৩৬ হাজার ৪৩৯টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫৭ হাজার ২৪৮টি কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণের হার ছিল ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ।
আর ২০২০ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে দেশে চার লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৭টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪৮ হাজার ৫৭৮ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণের হার ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
২০২১ সালের শুরু থেকেই করোনা সংক্রমণের ধারা ছিল নিম্নমুখী। জানুয়ারিতে চার লাখ ২৪ হাজার ১২৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ২১ হাজার ৬২৯ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণের হার ছিল ৫ দশমিক ১০ শতাংশ।
ফেব্রুয়ারি মাসে তিন লাখ ৯২ হাজার ৩০৫টি নমুনা পরীক্ষা করে সংক্রমণ নেমে আসে ১১ হাজার ৭৭ জনে। সংক্রমণের হারও নেমে আসে ২ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিল বাদ দিলে বাংলাদেশে মাসিক হিসেবে এই মাসেই সংক্রমণ ও সংক্রমণের হার ছিল সবচেয়ে কম।
এ বছরের মার্চ থেকে ফের বাড়তে থাকে সংক্রমণ। মার্চে ছয় লাখ ২৬ হাজার ৫৪৯টি নমুনা পরীক্ষা করে ৬৫ হাজার ৭৯ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণের হার ছিল ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
এপ্রিলে প্রথমবারের মতো কোনো মাসে লক্ষাধিক সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে সাত লাখ ৯৯ হাজার ১২৮টি নমুনা পরীক্ষা করে সংক্রমণ পাওয়া যায় এক লাখ ৪৭ হাজার ৮৩৭টি। সংক্রমণের হার ছিল ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ।
মে মাসে ফের নিম্নমুখী ছিল সংক্রমণ। চার ৭৭ হাজার ৮০৯টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪১ হাজার ৪০৮ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণের হার ছিল ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
জুনে ফের বাড়ে সংক্রমণ। ছয় লাখ ৬১ হাজার ৪১৪টি নমুনা পরীক্ষা এক লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণের হার ছিল ১৭ দশমিক ০৪ শতাংশ।
আর জুলাই তো সব ধরনের রেকর্ডভাঙা মাস। এই মাসে ১১ লাখ ৩১ হাজার ৯৬৭ টি নমুনা পরীক্ষা করে তিন লাখ ৩৬ হাজার ২২৬ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ২৯ দশমিক ৭০ শতাংশ।
অন্যদিকে, আগস্টের মাত্র চার দিনেই সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৬০ হাজার ৪২৬ জনের মাঝে, যা গড়ে ১৫ হাজারেরও বেশি। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আগস্ট মাস সংক্রমণের দিক থেকে ছাড়িয়ে যাবে জুলাই মাসকেও।
এ পরিস্থিতিতে করণীয়
চলমান করোনা পরিস্থিতিতে করণীয় কী— জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, সংক্রমণ বাড়লেই বয়স্ক মানুষদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা বাড়বে। অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্তদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। আর বয়স্ক এবং এ ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত হলে মৃত্যুর হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। তাই সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
ডা. আলমগীর মনে করেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে সবচেয়ে জরুরি হলো ব্যক্তির সচেতনতা। সরকার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নিয়ে বাস্তবায়ন করবে কিন্তু ব্যক্তি যদি সচেতন হয়ে সরকারি পদক্ষেপে সহযোগিতা না করে, তবে বিপদ বাড়বে। কারণ, কোনো এলাকায় একজন সংক্রমিত হলেই তার পরিবার-সমাজে সংক্রমণ ছড়াবে।
এ কারণে সবাইকে মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সচেতন থাকার পাশাপাশি, মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে এবং নমুনা পরীক্ষা করে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেন আইইডিসিআরের এই কর্মকর্তা।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর