‘আমি শিক্ষক নই, চিরকালের ছাত্র’
৫ আগস্ট ২০২১ ২০:০১
ড. অনুপম সেন। তার যখন জন্ম হয় তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। বোমাবর্ষণ, যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু মানুষের হাহাকার, দুর্ভিক্ষ— এমন অস্থিরতার মধ্যেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। সেই অস্থির সময় তার মনোজগতে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছিল। সেই বেড়ে ওঠার সময়ই তাকে দিয়েছে মানবিক পৃথিবী গড়ার সংগ্রামের দীক্ষা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষকতা পেশা।
ষাটের দশকে যৌবনে ভালোবেসে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন অনুপম সেন। এই শিক্ষকতা করতে গিয়েই পাকিস্তান আমল থেকে সব গণআন্দোলনে সম্পৃক্ত করেছেন নিজেকে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক, মানবিক সমাজ গড়ার আন্দোলনে পালন করেছেন অগ্রণী ভূমিকা। প্রগতিশীল সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে দেশে যেমন পেয়েছেন অকুণ্ঠ সম্মান, তেমনি বিশ্বসভায়ও সম্মানিত হয়েছেন। শিক্ষায় পেয়েছেন একুশে পদক।
বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) ৮০ বছর পূর্ণ করেছেন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী অনুপম সেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসেও শিক্ষকতাতেই আছেন তিনি। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন। জন্মদিনে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যালয়ে বসে সারাবাংলার মুখোমুখি হন তিনি। এদিন সারাবাংলার সঙ্গে একান্ত আলাপে তুলে ধরেন তার স্বপ্নের কথা। তার সঙ্গে আলাপচারিতায় ছিলেন সারাবাংলার স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট রমেন দাশগুপ্ত।
জ্ঞানের চর্চায় নিরন্তর নিবেদিত থাকা মানুষটি বলেছেন, তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ‘শিখে যেতে চান’। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি সবসময় শিখি। আমি কখনোই শিক্ষক নই। আমি চিরকাল ছাত্র। আমি সবসময় দেখি- কারও না কারও কাছ থেকে, কিছু না কিছু শেখার আছে। অনেকের কাছ থেকেই অনেককিছু শেখার আছে। সুতরাং যার কাছ থেকে শিখি তিনিই শিক্ষক, আমি চিরকালের ছাত্র।’
শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘আমার যখন জন্মা, তখন এই উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসনে ছিল। ১৯৪০ সালের ৫ আগস্ট আমার জন্ম। সেসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। আমার জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। শহরে আমার বাবার একটা পাকা বাড়ি ছিল। বিয়াল্লিশের শেষদিকে অথবা তেতাল্লিশের প্রথম দিকে, আমার তো তখন বোঝার বয়স হয়নি, মা-বাবার মুখে যা শুনেছি- আমাদের বাড়িটি ব্রিটিশ সরকার দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেসব সামরিক অফিসার জড়িত ছিলেন এবং চট্টগ্রামে ছিলেন, তাদের রেস্টহাউজ হিসেবে তারা আমাদের বাড়িটি ব্যবহার শুরু করেন।’
‘তখন চট্টগ্রামে বোমাবর্ষণ হচ্ছিল। জাপানিরা পুরো বার্মা দখল করে নিয়েছিল। এর পর চট্টগ্রামেও বোমাবর্ষণ শুরু করে। ১৯৪৩ সালে সারা বাংলাজুড়ে বিরাট দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। সেই দুর্ভিক্ষ আমি তখন সেভাবে যদিও বুঝিনি, আমার স্মৃতিতে নেই। মায়ের মুখে শুনেছি, তিনি সেসময় আমাদের নিয়ে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। সেই দুর্ভিক্ষের পর একসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল। তো, বাড়িটা দখলের পর আমরা গ্রামের বাড়ি ধলঘাটে চলে গিয়েছিলাম।’
‘গ্রাম থেকে ফিরে আসি ১৯৪৬ সালের শেষদিকে অথবা ১৯৪৭ সালে। গ্রামের স্মৃতিটা এখনও আমার কাছে খুবই উজ্জ্বল। সেই আমলে ধলঘাট স্কুল, অত্যন্ত পুরনো স্কুল। স্কুলটি আমার জ্যেঠামশাই শশাঙ্কমোহন সেন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমার মনে আছে- ধলঘাট স্কুলের সেই পুকুরটা, তার পানি এত স্বচ্ছ ছিল যে, নিচ দিয়ে যাওয়া মাছগুলো পর্যন্ত তখন দেখা যেত। আমি সেই পুকুরে অনেক সাঁতার কেটেছি। ধলঘাট স্কুলটা কিন্তু মাটির ছিল। স্কুলের সামনে মাঠ ছিল বিশাল। সেই মাঠে কত খেলেছি, কাদার মধ্যে কত গড়াগড়ি দিয়েছি, সেই স্মৃতি এখনও মনে পড়ে, খুব ভালো লাগে।’
সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেছেন তিনি, বোঝার বয়স তখন যথেষ্ঠ। দেখেছেন অসংখ্য লোকের এ-পাড় থেকে ও-পাড়ে চলে যাওয়া; আবার ও-পাড় থেকে এ-পাড়ে আসা। তার ভাষায়, এ এক বিরাট বিপর্যয় সারা উপমহাদেশ জুড়ে !
বিষন্ন সুরে বললেন, ‘কয়েক কোটি লোক দেশান্তরী হলো। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সম্ভবত এক কোটির ওপর লোক নিহত হল। ১৯৪৬, ৪৭ এবং ৫০ সালে এখানকার বিভিন্ন এলাকায় দাঙ্গা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি হয়েছিল পাঞ্জাবে। এক কোটির মতো লোক মারা যায়। কয়েক কোটি লোক উদ্বাস্তু হয়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানরা কিন্তু ও-পাড় থেকেই এদেশে এসেছিলেন। ১৯৫০ সালে উভয়বঙ্গে দাঙ্গা হয়। অনেক লোক চলে যায়। তখন কিন্তু পাসপোর্ট-ভিসা ছিল না।’
‘সেই দাঙ্গার সময় আমাকে এবং আমার আড়াই বছরের বড় দিদিকে আমার ছোট মামার কাছে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মা। মামা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন। আমরা সেখানে তিনবছর পড়ালেখা করেছিলাম। ১৯৫৩ সালে পাসপোর্ট-ভিসার প্রচলন হলো। তখন মা আমাদের চট্টগ্রামে নিয়ে এলেন। তখন ঘরে ঘরে খোঁজ নেওয়া হচ্ছিল কে-কোথায় আছে। মিউনিসিপ্যাল স্কুল থেকে ১৯৫৬ সালে মেট্রিকুলেশন পাস করি।’
অনুপম সেন চট্টগ্রাম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট, এরপর ১৯৬২ সালে সমাজতত্ত্বে স্নাতক ডিগ্রি নেন। ১৯৬৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ১৯৬৫ সালে ২৫ বছর বয়সে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। তিনি পূর্ব পাকিস্তান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক পদে যোগ দেন।
শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারে আসলে সবাই সাহিত্যের চর্চা করেছেন। আমার বাবা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে এম এ করেছিলেন এবং পরে আইনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেছেন। তিনি কোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। আমার জ্যেঠামশাইও ল’ইয়ার ছিলেন। কিন্তু আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তে যাই, সমাজবিজ্ঞান বিভাগে, সেখানে আমি একজন অসাধারণ শিক্ষক পেলাম, প্রফেসর ড. এ কে নাজমুল করিম। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ যখন প্রতিষ্ঠা হয়, তিনি সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, নাজমুল করিম তখন সেখানকার শিক্ষক। দেশ যখন ভাগ হলো, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন নাজমুল করিম। আমি উনার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর পড়ার সুযোগ পেয়েছি। উনি তখন আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন শিক্ষকতার জন্য। তিনিই আমাকে এখন যেটা বুয়েট, সেখানে শিক্ষকতা করতে পাঠিয়েছিলেন। অবশ্য তার আগে আমি কিছুদিন চট্টগ্রামে সিটি কলেজে শিক্ষকতা করেছি।’
বেড়ে ওঠার সময়ে যুদ্ধ-মন্বন্তরের অভিজ্ঞতা শিক্ষকতায় এসে তাকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়— বললেন অনুপমন সেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার বেড়ে ওঠার সময়টা আমাকে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করেছে। ভাত চাই না, ফ্যান দে মা- ভাত চেয়ে মানুষের এই ক্রন্দনের কথা আমি ছোটবেলায় মায়ের মুখে শুনেছি। তবে শিক্ষকতায় এসে এত এত মহান ব্যক্তির পরিচয় পেয়েছি গ্রন্থের মধ্যে। যেখান থেকে জীবনবোধকে নতুনভাবে ভাবতে শিখলাম। মানবসভ্যতার শুরু যখন হয়েছে, তখন একদিকে মানুষকে যে কত কষ্টের জীবন বহন করতে হয়েছে, সেটা উপলব্দি যেমন করতে পারলাম, তেমনি সেসময়ের অসাধারণ সব সৃষ্টি, অসাধারণ সব সাহিত্য, স্থাপত্য, চিত্রকলা সেগুলোকেও পেয়েছি। মানুষের ওপর মানুষের নিপীড়ন, দাসপ্রথা, ভূমিদাস প্রথা, দারিদ্যের যে কষ্ট- সেটা যেমন উপলব্ধি করেছি, আবার মানুষের অসাধারণ মমত্ববোধও ভাবনায় নিয়েছি। সমাজবিজ্ঞান আর ইতিহাসের নানা শাখায় আমি ঘুরেছি, জেনেছি।’
সেই থেকে একটি মানবিক পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন আরও গাঢ় হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন যে, আমরা এখনও প্রাগৈতিহাসিক যুগে রয়েছি। এখনও আমাদের ইতিহাস শুরু হয়নি। আসলেই এখনও মানবজাতির ইতিহাস শুরু হয়নি। এই মানবজাতি যে এখনও কোথায় পড়ে আছে, মানবজাতিকে কতদূর যে যেতে হবে- এটা যখন ভাবি মনটা তখন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ লোক এখনও দারিদ্র্যে নিমজ্জিত। তারা জীবনকে জীবন হিসেবে উপলব্ধি করতে পারে না। তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, বিনোদনের সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এই দুই-তৃতীয়াংশ লোককে যতক্ষণ মানুষের মর্যাদায় অভিষিক্ত করা না যাবে, ততদিন মানুষের ইতিহাস শুরু হতে পারে না। মানুষ মানুষের মর্যাদা না পাওয়া পর্যন্ত মানুষের ইতিহাস শুরু হতে পারে না।’
বাংলাদেশকে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখার স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি জানিয়ে অনুপম সেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর যে সংবিধান আমাদের দিয়েছিলেন, সেই সংবিধানে লেখা ছিল- বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে হবে। সেই প্রতিজ্ঞা আমাদের পূরণ করতে হবে। আমাদের অনেকদূর যেতে হবে। আমরা মাত্র সূচনা করেছি। কিন্তু সেই সূচনার পথ এত মসৃণ নয়। এটি নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই বাংলাদেশ যেদিন প্রতিটি মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে পারবে, তাদের জীবনকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারবে, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ করতে পারব, সেদিনই সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ একটি মানবিক রাষ্ট্র হবে।’
‘তবে আমি আশাবাদী যে, মানুষ এগোচ্ছে এবং মানবিকভাবে এগোচ্ছে। মানুষ এগোবে। একদিন সারা বিশ্বজুড়ে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে’— বলেন ড. অনুপম সেন।
ভালোবাসায় কাটলো জন্মদিন
করোনাকালে কর্মস্থল প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যালয়ে তেমন আসেন না উপাচার্য ড. অনুপম সেন। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুরোধে বৃহস্পতিবার সকালে একবার তাকে ঘুরে যেতে হয়েছে ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পক্ষ থেকে তাকে ফুল দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো হয়।
এ সময় তিনি বলেন, ‘প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসেবে অনেক বছর দায়িত্ব পালন করছি। যদিও আমি জন্মদিন পালন করি না, কিন্তু প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি আমার জন্মদিন পালন করে। এতে আমি আনন্দিত। ইউনিভার্সিটি পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ। আমার জন্মদিনে সবার ভালোবাসায় আমি অভিভূত। প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি শুধু বাংলাদেশ নয়, বাইরেও সুনাম অর্জন করেছে। আমার বিশ্বাস, একদিন এই ইউনিভার্সিটির সুনাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার প্রফেসর এ কে এম তফজল হক, প্রকৌশল ও বিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. তৌফিক সাঈদ, রেজিস্ট্রার খুরশিদুর রহমান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শেখ মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান ইফতেখার মনির।
ছবি: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম