হোটেল-মোটেলের ব্যবসা নেই, ছাঁটাইয়ের শিকার কর্মচারীরা
৭ আগস্ট ২০২১ ১১:১১
রাঙ্গামাটি: বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারি ঘোষণায় বন্ধ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলার হোটেল-মোটেল, রেস্ট হাউজ, কটেজ-রিসোর্ট। তাতে বেহাল দশা এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর। মালিকদের জন্য ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনোমতে টিকে থাকতে অনেকেই বেছে নিয়েছেন ছাঁটাইয়ের পথ। তাতে চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে কর্মচারীদের। যারা এখনো চাকরিতে আছেন, ব্যবসা মন্দার কারণে তারাও নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন হোটেল-মোটেল মালিকরা।
এই খাতের সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে, গত বছরের ১৯ মার্চ থেকে তিন পার্বত্য জেলার সব পর্যটন স্পট ও বিনোদনকেন্দ্রে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে স্থানীয় জেলা প্রশাসন। একইসঙ্গে তিন জেলার সব হোটেল-মোটেল, রেস্ট হাউজ, কটেজ-রিসোর্ট বন্ধ রাখার নির্দেশনাও দেওয়া হয়। এতে বেকার হয়ে পড়েন শ্রমিক-কর্মচারীরা। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ছাঁটাই শুরু করে মালিকপক্ষ। পরে দেশে করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমলে সীমিত পরিসরে হোটেল-মোটেল কটেজ, রেস্ট হাউজ খুলে দেওয়া হয়। তবে পর্যটন ও বিনোদেনকেন্দ্রের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকায় বুকিং পায়নি হোটেল-মোটেলগুলো। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে চলতি বছরের মার্চের শেষ দিক থেকে এখনো পর্যন্ত ফের হোটেল-মোটেল বন্ধে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
মালিক সমিতি ও সংশ্লিষ্টদের তথ্য বলছে, তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটন শিল্পে আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস বলা চলে আবাসিক খাতকে। এ তিন জেলায় তিন শতাধিক হোটেল-মোটেল, কটেজ-রিসোর্ট ও রেস্ট হাউজ রয়েছে। এর মধ্যে রাঙ্গামাটি জেলার মেঘের উপত্যকা খ্যাত ‘সাজেক ভ্যালি’তে এর সংখ্যা ১২০টিরও বেশি।
রাঙ্গামাটি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের পর্যটন মোটেলের ব্যবসাটা কেবল পর্যটন মৌসুমকেন্দ্রিক না। সারাবছর আমাদের ব্যবসা হতো। পর্যটন মৌসুমে পর্যটকদের চাপ থাকলেও অন্যসময়গুলোতে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রোগ্রামসহ নানা ধরনের প্রোগ্রামের ব্যস্ততা থাকত। কিন্তু গত পুরো চার মাসে আমরা একেবারে স্থবির হয়ে পড়েছি। বলা যায় একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আমাদের বেশিরভাগ কর্মচারীকে টানা ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এই সময়টাতে তাদের বেতন-ভাতা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, মূলত পর্যটন করপোরেশন নিজস্ব নির্ভরতার প্রতিষ্ঠান। নিজস্ব আয় দিয়েই এই প্রতিষ্ঠান স্টাফ, আনুষাঙ্গিকসহ খরচ বহন করে থাকে। কিন্তু এখন আমাদের খরচ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এক পয়সাও আয় হচ্ছে না।
রাঙ্গামাটির আবাসিক হোটেল মতি মহলের স্বত্বাধিকারী মো. শফিউল আজম বলেন, পর্যটন খাত বন্ধের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আবাসিক খাত। আমরা ভর্তুকি দিয়ে কোনোমতে টিকে আছি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে ও দেখভালের জন্য দুয়েকজন কর্মচারী দিয়ে চালাতে হচ্ছে। নিরুপায় হয়ে বাকিদের ছাঁটাই করতে হয়েছে। আমরা বুঝতে পারছি, কর্মচারীদের যারা কাজ হারিয়েছে, তারা বেকার হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। অনেকেই বাধ্য হয়ে পেশা বদল করেছে। কিন্তু বেশিরভাগই সেটি করতে পারেনি। ফলে দারিদ্র্যের হার বেড়ে গেছে।
খাগড়াছড়ি জেলা পর্যটন মোটেলের ব্যবস্থাপক এ কে এম রফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতেও মোটেলের আবাসিকসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ১৪-১৫ লাখ টাকার ব্যবসা হয়েছে। করোনার দ্বিতীয় টেউ শুরু হওয়ার পর মার্চে সেটা নেমে গেছে ৬-৭ লাখ টাকা। এরপর তো একদম বসে পড়েছি।
তিনি বলেন, গত বছর করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন। পুরো খাগড়াছড়িতে ৫০-৬০টি হোটেল-মোটেল ও রেস্ট হাউজ রয়েছে। করোনার উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। বেশিরভাগ হোটেল মালিকরা প্রতিষ্ঠান বাঁচানোর তাগিদে কর্মচারীদের ছাঁটাই করেছেন। অনেকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দুয়েকজনকে রেখে বাকি সবাইকে ছাঁটাই করেছেন। আমাদের মোটেলেই যেখানে ১৮-১৯ জন কর্মচারী কাজ করত, সেখানে এখন সাত-আট জন দিয়ে সামলাতে হচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও বেহাল দশা।
রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘বিশেষত পর্যটন মৌসুম খাগড়াছড়িতে হোটেল-মোটেলের পাশাপাশি খাবার হোটেল, রেস্টুরেস্ট, চান্দের গাড়িসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট সবকিছু মিলিয়ে মাসিক গড়ে ৬০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে। সাজেকের হিসাব যোগ হলে মাসে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে পাঁচ থেকে ছয়শ কোটিতে। কারণ সাজেকের পর্যটন খাত থেকে দৈনিক রাজস্ব আয় আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা। এখন করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ নেই।’
রাঙ্গামাটির সাজেক কটেজ মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অনিত্য ত্রিপুরা জানান, সাজেকে তাদের সমিতির তালিকাভুক্ত কটেজ-রিসোর্টের সংখ্যা ৮২। সমিতির তালিকাভুক্তির বাইরে আরও প্রায় ৪০টি কটেজ-রিসোর্ট রয়েছে। করোনার কারণে গত বছরের ১৯ মার্চ থেকেই এখানকার কটেজ-রিসোর্ট ব্যবসা স্থবির। মাঝে সামান্য কিছুদিন খোলা থাকলেও এখন সব কটেজ বন্ধ। লোকসান এড়াতে অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার কথা ভাবছেন।
এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা আবাসিক হোটেল-মোটেল ও রেস্ট হাউজ মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের সমিতিভুক্ত ৪৫টি হোটেল-মোটেল, রেস্ট হাউজ ছাড়াও জেলায় মোট ৬০টির মতো আবাসিক হোটেল-মোটেল রয়েছে। ছাঁটাইয়ের কারণে এ খাতের শ্রমিক-কর্মচারীরা অনাহারে অর্ধহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আমাদের নিজেদেরও এখন ভর্তুকি দিতে দিতে পথে বসার অবস্থা।
জানতে চাইলে রাঙ্গামাটি জেলা আবাসিক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মঈনুদ্দীন সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, সমিতির তালিকাভুক্ত ৫৩টির বাইরেও বেশ কয়েকটি হোটেল-মোটেল, কটেজ রয়েছে রাঙ্গামাটিতে। চলতি বছরের মার্চের শেষ দিক থেকে এখন পর্যন্ত চার মাস পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে আমাদের কোনো ব্যবসা নেই। এই খাতের মালিক-কর্মচারী সবার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। বাধ্য হয়ে আমরা ৯০ শতাংশ কর্মচারীকে ছাঁটাই করেছি। কারণ তাদের রেখে বেতন-ভাতা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার প্রত্যেকেরই ঘর-সংসার আছে।
তিনি বলেন, পরিবহন খাতসহ অন্যান্য খাতের শ্রমিকরা সামান্য হলেও আর্থিক প্রণোদনা পেয়েছে। কিন্তু আমাদের পর্যটন খাত একেবারে নিভৃতে থেকে গেল। কারও কাছে কোনো সহায়তা মিলল না।
সারাবাংলা/টিআর