ভ্যাকসিন কম-মানুষ বেশি, ফিরে গেলেন অনেকে
৭ আগস্ট ২০২১ ২১:১৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ে গণটিকা কর্মসূচির প্রথমদিনে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ করোনার ভ্যাকসিন পেয়েছেন। তবে ভ্যাকসিনের চেয়ে কেন্দ্রে-কেন্দ্রে টিকাগ্রহীতার সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেককে লাইনে দাঁড়িয়েও শেষ পর্যন্ত ফেরত যেতে হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ‘টোকেনের’ মাধ্যমে নিজস্ব লোকজনকে ভ্যাকসিন পাইয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সারাদেশের মতো শনিবার (৭ আগস্ট) সকাল ৯টা থেকে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয় চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায়। এর প্রায় দেড়ঘণ্টা পর নগরীর পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডের রাহাত্তারপুল এলাকায় মজিদিয়া আলিয়া মাদরাসা প্রাঙ্গনে স্থাপিত কেন্দ্রে গিয়ে ভ্যাকসিন কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।
মেয়র রেজাউল করিম সাংবাদিকদের জানান, নগরীর ৪১ ওয়ার্ডের প্রতিটিতে তিনটি করে মোট ১২৩ কেন্দ্রে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে একটি করে বুথে ৩০০ ডোজ করে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে দুজন ভ্যাক্সিনেটর ও তিন জন স্বেচ্ছাসেবীসহ ৪১টি ওয়ার্ডে ২৪৬ জন প্রশিক্ষিত ভেক্সিনেটর ও ৩৬৯ জন সেচ্ছাসেবী দায়িত্ব পালন করেছেন। ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রে বয়োজ্যেষ্ঠ, নারী ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে বলে দাবি মেয়রের।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে ১২৩ কেন্দ্রে ৩৬ হাজার ৭৩৫ জনকে মডার্নার ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। নগরীর পাশাপাশি জেলার ১৫ উপজেলায় ২০০ ইউনিয়ন ও ছয় টি পৌরসভায় ১৯৭টি কেন্দ্রে মোট এক লাখ ২০ হাজার ৩৩০ জনকে সিনোফার্মার তৈরি করোনার ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। জেলায় প্রতি কেন্দ্রে ৬০০ ডোজ করে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।
সব মিলিয়ে মোট এক লাখ ৫৭ হাজার ৬৫ জনকে গণটিকা কর্মসূচির আওতায় জেলা ও নগরীতে একদিনে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের কর্মকর্তা সুজন বড়ুয়া। এর বাইরে নগরী ও জেলার স্থায়ী কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিনের মতো সুরক্ষা অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধিতদের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন কেন্দ্রে ভ্যাকসিন গ্রহীতার ভিড় দেখা গেছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে কেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন বয়সী নানা শ্রেণিপেশার মানুষ জড়ো হন ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য। এ সময় বিভিন্ন কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। স্থানীয় কাউন্সিলরদের পক্ষ থেকে মাইকের মাধ্যমে লোকজনকে বিশৃঙ্খলা না করার অনুরোধ করতে দেখা গেছে নগরীর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের আনসার ক্লাবসহ আশপাশের কয়েকটি কেন্দ্রে।
একইভাবে সারাবাংলা’র ফটো করেসপন্ডেন্ট শ্যামল নন্দী চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ফটিকছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে বিভিন্ন কেন্দ্রে ঘুরে ভ্যাকসিনপ্রত্যাশীদের ভিড় দেখেছেন। আনোয়ারা উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের পক্ষ থেকে প্রতি কেন্দ্রে ভ্যাকসিনগ্রহীতাদের মাস্ক, ফুল ও নাস্তা দেওয়া হয়েছে। তবে নগরী এবং গ্রামের প্রায় সব কেন্দ্রই ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় জনপ্রতিনিধির পাশাপাশি তাদের অনুসারী নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে।
নগরীর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ শহীদুল আলম, দেওয়ানবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনি এবং চান্দগাঁও ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. এসরারুল হক ‘টোকেন’ বিলি করেছেন। এসব ওয়ার্ডে যারা শুধুমাত্র টোকেন দেখাতে পেরেছেন, তারাই ভ্যাকসিন পেয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
টোকেনের বিষয়টি স্বীকার করে কাউন্সিলর শহীদুল আলম বলেন, ‘বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দুইদিন ধরে আমার ওয়ার্ডে নিবন্ধন হয়েছে। যারা নিবন্ধন করতে এসেছিলেন, প্রত্যেককে কার্ড দিয়েছি। অহেতুক কেন্দ্রে এসে ভিড় করে নিজেদের ভোগান্তি ও বিশৃঙ্খলা এড়াতে টোকেন দেওয়া হয়েছে।’
তবে নগরীর আন্দরকিল্লা, লালখান বাজারসহ বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে গিয়ে কোনো টোকেন পাওয়া যায়নি। সেখানে ‘আগে আসলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে নিবন্ধিতদের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ভোগান্তিও হয়েছে। যেসব ওয়ার্ডে টোকেন দেওয়া হয়েছে এবং যেখানে দেওয়া হয়নি-সব কেন্দ্র থেকেই অনেককে ভ্যাকসিন নিতে না পেরে ফেরত যেতে হয়েছে। তাদের ১৪ আগস্ট থেকে আবারও ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরুর পর যেতে বলা হয়েছে।
নগরীর হাজারী লেইনের বাসিন্দা সুমন দাশ ও তার স্ত্রীকে প্রথমে আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের আনসার ক্লাবে ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য যেতে বলা হয়। সকাল ১১টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, গেট বন্ধ। সংশ্লিষ্টরা তাদের ভ্যাকসিন শেষ হয়ে গেছে জানিয়ে এক কিলোমিটার দূরে পাথরঘাটায় মেনকা স্কুলে যেতে বলেন। সেখানে গিয়েও দেখেন ভ্যাকসিন শেষ। এরপর চেরাগি পাহাড়ে কদমমোবারক এম ওয়াই উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে ভ্যাকসিন পান।
সুমন দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুরুর দিনে খুব বিশৃঙ্খলা হয়েছে। লকডাউনের কারণে গাড়ি চলছে না। রিকশায় করে দুই ঘণ্টা ঘুরে তারপর ভ্যাকসিন পেয়েছি।’
লালখান বাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল হাসনাত বেলাল বলেন, “যারাই নিয়ম অনুযায়ী নিবন্ধন করেছেন, তাদের থেকে ‘আগে আসলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে সকাল নয়টা থেকে আমরা ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ৯০০ ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার পর কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি। এখানে জোর জবরদস্তির কোনো সুযোগ ছিল না।”
এদিকে নগরীর আলকরণ, চকবাজারসহ কয়েকটি ওয়ার্ডের কেন্দ্রগুলোতে বেশি লোক ভিড় করায় টিকা কেন্দ্রের বাইরে হট্টগোল হয়। সদরঘাটে সিটি করপোরেশন জেনারেল হাসপাতালে ভ্যাকসিন নিতে আসা লোকজনকে সরাতে এক পর্যায়ে পুলিশ মোতায়েন করতে হয়।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুরুর দিন হওয়ায় সামান্য বিশৃঙ্খলা ছিল। যে পরিমাণ মানুষ ভ্যাকসিন নিতে এসেছেন, আমাদের কাছে সেই পরিমাণ ভ্যাকসিন তো ছিল না। এজন্য ভ্যাকসিন দেওয়া শুরুর দুই ঘণ্টার মধ্যে কার্যক্রম শেষ করে দিতে হয়েছে আমাদের। অনেককে ফিরে যেতে হয়েছে। এতে আমাদেরও কষ্ট লাগছে। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ১৪ আগস্ট থেকে আবারও গণটিকা কার্যক্রম শুরু হবে। সরকার প্রতিটি নাগরিককে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে।’
টোকেনের মাধ্যমে টিকা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। এমন কোনো নির্দেশনা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কাউকে দেওয়া হয়নি।’
চট্টগ্রাম নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গলায় ‘স্বেচ্ছাসেবক পরিচয়পত্র’ ঝুলিয়ে তারা এ কার্যক্রমে অংশ নেন। পরিচয়পত্রে নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরের সই দেখা গেছে।
জাকারিয়া দস্তগীর সারাবাংলাকে জানান, নগরীর প্রতিটি টিকাদান কেন্দ্রে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে চারজন করে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর বাইরে যেখানে বেশি জনসমাগম হয়েছে সেখানে ১০ জনের আলাদা টিম কাজ করেছে।
ছাত্রলীগকে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব কারা দিয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারের ঘোষিত গণটিকা কর্মসূচি সফল করতে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছি। মহামারির শুরু থেকে সারাদেশে আমরা করোনা প্রতিরোধে কাজ করছি। ভ্যাকসিন নিয়ে কেউ যাতে মিথ্যাচার করে গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে, সেজন্য আমরা কেন্দ্রে ছিলাম।’
এদিকে হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ আদর্শ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের রজনীকান্ত হলে টিকাদান কেন্দ্রে পুলিশ, আনসার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সঙ্গে যুবলীগ-ছাত্রলীগের কর্মীদের স্বেচ্চাসেবকের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। সেখানেও টোকেনের মাধ্যমে ভ্যাকসিন প্রত্যাশীদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ফটিকছড়ির বিভিন্ন কেন্দ্রেও একই অবস্থা দেখা গেছে।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল আলম বলেন, ‘আগে রেজিস্ট্রেশন করেছেন এমন সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু আমরা দিতে পারবে ৬০০ জন। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টোকেন দেওয়া হয়েছে; যাতে সবাই কেন্দ্রে এসে ভিড় না করেন।’
ছবি: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম