‘তোরা আমাকে যেতে দে, আর আটকাস না; ছেলেটাকে বাঁচা’
৮ আগস্ট ২০২১ ১১:৩৭
ঢাকা: ‘অনেক তো করলি আমার জন্য, আর কত? এবার তোরা আমাকে যেতে দে, আর আটকাস না; ছেলেটাকে বাঁচা। টাকাপয়সারও তো বিষয় আছে। আমার ছেলেটার দিকে খেয়াল রাখ। অন্তত ছেলেটা বেঁচে থাকলে তার বৌ এবং বাচ্চাসহ পরিবারটাকে সে টিকিয়ে রাখতে পারবে।’— কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে রাজধানীর কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে পাশাপাশি বেডে চিকিৎসাধীন মা সুরাইয়া জাহান (ছদ্মনাম) এভাবেই কথা বলছিলেন তার মেয়ের সঙ্গে। কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে একমাত্র ছেলে আশিকুজ্জামান (ছদ্মনাম) তার পাশেই চিকিৎসাধীন আরেকটি বেডে।
কুমিল্লার সুরাইয়া জাহান স্বামীকে হারান ২০০৩ সালে। দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়েই জীবন সংগ্রামে টিকে ছিলেন। ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা শেষে চাকরিতে প্রবেশের আগেই নিজে ক্যানসার আক্রান্ত হন। ব্রেস্ট ক্যানসার ও ওভেরিয়ান ক্যানসারে আক্রান্ত সুরাইয়া জাহানের বড় মেয়ে আনিকা জাহান (ছদ্মনাম) রাজধানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ছোট মেয়ে সারিকা জাহান (ছদ্মনাম) কুমিল্লায় একটি বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করলেও কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে সেটি বন্ধ। একমাত্র ছেলে আশিকুজ্জামান রাজধানীতে একটি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টসে চাকরি করেন।
ঈদুল আজহার বন্ধে কোভিড-১৯ সংক্রমণের আশঙ্কায় গ্রামের বাড়িতে এবার কারোরই কুমিল্লা যাওয়া হয়নি। তবে তাতেও শেষ রক্ষা হলো এই পরিবারের সদস্যদের। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেও জ্বর জ্বর ভাব অনুভব করতে থাকেন আশিকুজ্জামান। নমুনা পরীক্ষা করালে তাতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। একই সঙ্গে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয় তার বড় বোনের স্বামীরও। সিটি স্ক্যান করে জানা যায় আশিকুজ্জামানের ফুসফুসে ৫০ শতাংশ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। অবস্থার অবনতি হলে তাকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রোগীদের সাধারণ শয্যা খালি না থাকলেও অনুরোধে বেড বাড়িয়ে ভর্তি করা হয় তাকে।
আশিকুজ্জামানের সঙ্গে হাসপাতালে দেখা শোনার জন্য থাকেন তার বড় বোন আনিকা জাহান। বাসায় মা, স্বামীকে রেখে তিনি হাসপাতালের ভাইয়ের সেবা করতে থাকেন।
প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান তার মায়েরও কোভিড-১৯ সংক্রমিত হওয়ার কথা। কিন্তু একই হাসপাতালে বেড খালি না থাকায় তাকে আর হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছিল না।
আনিকা জাহান বলেন, ‘আম্মুর তো অনেকগুলো ইস্যুই আছে আগে থেকে। আমরা চেষ্টা করে গেছি সবাই মিলে। এখন আশিকুজ্জামানের ফুসফুসে সংক্রমণ পাওয়া গেছে ৫০ শতাংশ। এমন অবস্থায় আসলে তার চিকিৎসাটা জরুরি। আম্মু বাসায় ছিলেন, তবে তার শরীর দুর্বল। খাওয়া-দাওয়া স্বাভাবিকভাবে করছিলেন না।’
পরদিনই পরিস্থিতির অবনতি হলে সুরাইয়া জাহানকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে ভর্তির আগে অক্সিজেন স্যাচুরেশন নেমে আসে ৭০-এ। এমন অবস্থায় কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালেই তাকে ভর্তি করে অক্সিজেন দেওয়া হয়। সরকারিভাবে হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ কম হলেও কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের জন্য বাইরে থেকে কিছু ওষুধ কিনে আনতে হয়। আর সেটা মেটাতেই পরিবারটি হিমশিম খাচ্ছিল।
আনিকা জাহান বলেন, ‘আম্মুর তো নানা ধরনের জটিলতা আছে। অনেক দিন থেকেই চিকিৎসা করানো হচ্ছে। বর্তমানে এখানে তাদের জন্য কিছু ইনজেকশন কিনতে হচ্ছে প্রতিদিনই। আসলে কীভাবে কী করব তা বুঝে উঠতে পারছি না। আম্মুর যে অবস্থা তাতে মনে হয় আরও বেশ কয়েকদিন তাকে এখানে থাকতে হবে। এদিকে আমারও গলাব্যাথা ও জ্বর আসছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। সবাই চেষ্টা করে এতদিন যা করেছি তা সামনে কীভাবে অব্যাহত রাখব তা বুঝে উঠতে পারছি না। এরইমধ্যে ৫০ হাজারের মতোন খরচ হয়ে গেছে। হাতে আর মাত্র ১০ হাজার টাকা আছে। সামনে কীভাবে কী করব বুঝে উঠতে পারছি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আম্মুর শরীর গতকাল একদম ছেড়ে দিয়েছিল। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগাতে চাচ্ছিল না। আমাকে বারবার বলছিল, আমাকে এবার তোরা যেতে দে। আর কত করবি? এবার আমাকে ছেড়ে দে, ছেলেটাকে দেখ। আশিকুজ্জামানের ঘরে বৌ আছে, বাচ্চা আছে। তার সামনে পুরো জীবনটাই তো পড়ে আছে। আমার জন্য খরচ না করে তার জন্য চিন্তা-ভাবনা কর।’
আনিকা জাহান বলেন, ‘আম্মুর জন্য আইসিইউ লাগবে বলে জানিয়েছে চিকিৎসক। কিন্তু এখানে তো কোনো আইসিইউ বেড খালি নেই। তাই কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। বেসরকারিতে আইসিইউ খরচ আমরা কুলিয়ে উঠতে পারব না। আর সেখানে যদি কোনো ইনজেকশন দেওয়া হয় তবে সেগুলো ম্যানেজ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে।’
তিন বলেন, ‘আম্মুও হয়তো চিকিৎসা খরচ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আর তাই চাচ্ছে, ছেলেটা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক। আর সেজন্য আমাদের বলছে ছেড়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু যে যাই বলুক মাকে তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না।’
অবশ্য পরবর্তী সময়ে আইসিইউ যোগাড় করা হয় সুরাইয়া জাহানের জন্য।
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান ডা. আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুরাইয়া জাহানের ব্রেস্ট ও ওভেরিয়ান ক্যানসারের হিস্ট্রি আছে। আমরা এখানে তার অক্সিজেন লেভেলটাও আপ-ডাউন করতে দেখছি। আপাতত আমরা ৬০ থেকে ৭০ লিটার অক্সিজেন দিচ্ছি তাকে। এখানে অবশ্য সরকারি হাসপাতাল হিসেবে সব ধরনের সুযোগ সুবিধাই উনি পাবেন। কিন্তু তাও উনার অবস্থা কিন্তু স্থিতিশীল না। আর এমন অবস্থায় আসলে আমরা উপসর্গ দেখেই এখন পর্যন্ত চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে বাইরে থেকে কিছু ইনজেকশন তো ট্রাই করে দেখতেই হয়। একবারে তো আর হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না।’
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় আশিকুজ্জামানের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে এদিন থেকে কোভিড-১৯ উপসর্গ দেখা যাচ্ছে আনিকা জাহানের মাঝে। আর তাই সে বাসায় চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। বড় বোনের পরিবর্তে মায়ের সেবা করতে আসা সারিকা জাহান হাসপাতালে মা ও ভাইয়ের সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছে।
এদিকে শনিবার (৭ আগস্ট) সারাদেশে ৩১ হাজার ৭১৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৮ হাজার ১৩৬ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ দিন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যায় ২৬১ জন। যা দেশের হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর পরিসংখ্যান ২৪ ঘণ্টা সময়সীমায়।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম