বাবার আদর্শের কাছে আমার মা জীবন উৎসর্গ করেছেন: প্রধানমন্ত্রী
৮ আগস্ট ২০২১ ১৭:২৯
ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমার বাবা রাজনীতি করেছেন সেই রাজনীতির আদর্শের কাছে আমার মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তার জীবনটি উৎসর্গ করেছেন। কখনও রাজনৈতিক নেতা হতে হবে বা রাজনৈতিকভাবে কিছু পেতে হবে, সেই চিন্তা আমার মায়ের ছিল না। কোনো সম্পদের প্রতিও তার মোহ ছিল না। নিজের যতটুকু ছিল সেইটুকুই। এভাবেই তিনি নিজের জীবনকে গড়ে তুলেছেন।
রোববার ( ৮ আগস্ট) গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন’ ও ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পদক-২০২১ প্রদান’ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি এ কথা বলেন।
রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন প্রান্ত থেকে পদকপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ জোবেদা খাতুন পারুল অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা পাঁচ বিশিষ্ট নারী ও তাদের অনুপস্থিতে পরিবারের সদস্যদের হাতে ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব’ পদক পদক তুলে দেন।
একইদিন সারাদেশে দুই হাজার দুস্থ নারীকে নগদ দুই হাজার টাকা করে মোট ৪০ লাখ টাকা এবং চার হাজার সেলাই মেশিন বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এ সময় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রণালয়ের সচিব মো.সায়েদুল ইসলাম, জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান চেমন আরা তৈয়ব, প্রবীণ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রান্ত থেকেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে সংযুক্ত ছিলেন।
অন্তরালে মায়ের ভূমিকার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ দেশের রাজনীতিতে আমার মায়ের অবদান রয়েছে। শুধু তাই বাংলার মানুষের কী প্রয়োজন, কী চাহিদা সে সব বিষয়েও আমরা মা জানতেন। এ ছাড়া শিক্ষার প্রতিও আমার মায়ের প্রবল আগ্রহ ছিল।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু অধিকার অধিকার বলে চিৎকার করলে হবে না। অধিকার আদায় করতে হলে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। প্রত্যেকে মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত- এই বিষয়টি আমার মা উপলব্ধি করেছেন। প্রতিটি সংগ্রামে আমার মায়ের অবদান রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সবসময় রিপোর্ট দিত। সেই রিপোর্টগুলো আমি প্রকাশ করেছি। সেখানে কিন্তু আমি একটি জিনিস খুঁজে বেড়িয়েছি, সেখানে আমার মায়ের কোনো কথা লেখা আছে কি না? কিন্তু সেখানে আমার বিরুদ্ধে কিছু লিখতে পারেননি। অথচ আমার মা রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল, গোপনে দলের লোকের সঙ্গে দেখা করা, ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, তাদেরকে নির্দেশনা দেওয়ার কাজ আমার মা করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘এই যে একটা গেরিলা যুদ্ধে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমি সবসময় বলি যে আমার মা ছিলেন সব থেকে বড় গেরিলা। অসামান্য স্মরণশক্তি ছিল তার। বাংলাদেশের কয়েকটি বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে, সেই সিদ্ধান্তগুলো আমার মা সঠিক সময়ে নিয়েছিলেন বলেই আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি।’
ছয় দফা আন্দোলনের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘ছয় দফা না আট দফা এটা নিয়ে চরম বিতর্ক, সেই ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং তো আমাদের বাসাতেও হয়েছে। আমাদের আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতারা চলে গেছেন আট দফার পক্ষে। কারণ পাকিস্তান থেকে নেতারা এসেছেন সেই আট দফার পক্ষ নিয়ে। কিন্তু আট দফা ছিল একটি শুভঙ্করের ফাঁকি। এটি তাদের মতো শিক্ষিত অনেকেই হয়ত ধরতে পারেননি। কিন্তু আমার মায়ের কাছে সেটা স্পষ্ট ছিল। এখানে আমার মায়ের স্পষ্ট কথা ছিল ছয় দফার একটা দাঁড়ি কমা সেমিকোলনও বদলাবে না। যেটি তিনি বলে গেছেন, সেটিই হবে। সেই সিদ্ধান্তই ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে নেওয়া হয়েছিল।’
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার ষড়যন্ত্রের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আইয়ুব খান মিটিং ডেকেছে যেতেই হবে। প্যারোলে যাওয়াটা আমার মায়ের কাছে ছিল অত্যন্ত অসম্মানজনক। আইয়ুব খান যদি আলোচনা করতে চায় সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। কারণ মায়ের কথা, রীতিমতো তখন আন্দোলন চলছে, গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। কিন্তু আমাদের অনেক বড় বড় নেতা, আইনজীবী, সাংবাদিক অনেকেই তখন প্যারোলে যাওয়ার প্রচণ্ড চাপ। আমার মা কিন্তু সেখানে একেবারে দৃঢ়ভাবে সদ্ধিান্ত নিয়েছিলেন। যদি এই সিদ্ধান্তটা সঠিকভাবে না নিতেন আর খবর আমার বাবার কাছে না পৌঁছাতেন তাহলে বাংলাদেশ কোনোদিন স্বাধীন হতো না।’
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই ভাষণের সময়ও অনেকের অনেক কথা ছিল। তা হলে তো জালিনওয়ালাবাগের মতো ঘটনা ঘটে যেত। ওখান থেকে একটি মানুষও জীবিত ফিরে যেতে পারত না। আর কোনদিন যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করা যেত না। সেখানে আমার মায়ের যে পরামর্শ সেটাই কিন্তু বাংলাদেশের ভাগ্যকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যার জন্য আমরা যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করি।’
বঙ্গমাতার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সব থেকে বড় কথা নিজের জীবনটাকে তিনি খুব সাদাসিধা রেখেছেন। আমার আব্বা যখন প্রধানমন্ত্রী গণভবনে বা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের এই বিলাসিতার মধ্যে যেন আমরা না থাকি সেই বিষয়েও মায়ের নজর ছিল। মায়ের কথা হলো আমরা যদি এই বিলাসিতার মধ্যে মানুষ হই তাহলে আমাদের অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে, নজর খারাপ হয়ে যাবে। ওই ৩২ নম্বরের বাড়ি ছেড়ে তিনি কখনও আসেননি। তিনি এসেছেন হয়ত ঘুরে গেছেন এটুকুই। কিন্তু সেখানে বসবাস করার কথা কখনো চিন্তাই করেননি। আমার মাকে আমি সবসময় একই রকমই দেখেছি। কখনো কোনো ব্যাপারে তিনি বেশি বিলাসিতা পছন্দ করতেন না।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘৭৫ এর ১৫ আগস্ট মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মা। মানুষ যখন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায় চেষ্টা করে নিজের জীবন বাঁচাতে, চেষ্টা করে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে। আমার মা কিন্তু খুনিদের কাছে নিজের জীবন ভিক্ষা চাননি, তিনি নিজের জীবন দিয়েছেন। আমার বাবাকে যখন হত্যা করলে তখন তিনি দেখে খুনিদের বললেন, তোমরা ওনাকে মেরে ফেলেছো, আমাকেও মেরে ফেলো।’
ঘাতকদের বন্দুক গর্জে উঠেছিল এবং সেখানেই তারা আমার মাকে নির্মমভাবে হত্যা করে বলে মন্তব্য করে আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু কন্যা। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারের কেউ বেঁচে ছিল না। আমরা দুই বোন বিদেশে ছিলাম। কতটা সাহস থাকলে মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবন ভিক্ষা না করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের অবহেলিত নারী সমাজ আজকে একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছে। আমি মনে করি আমার মায়ের জীবনের এই কাহিনী শুনলে অনেকেই হয়ত অনুপ্রেরণা পাবে। শক্তি-সাহস পাবে। দেশের জন্য জাতির মঙ্গলে কাজ করবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৫ আগস্ট আমি আপনজন সবাইকে হারিয়েছি। শুধু একটাই প্রশ্ন, কেন এই হত্যাকাণ্ড? কী অপরাধ ছিল আমার বাবার? আমার মায়ের, আমার ভাইদের। যারা নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করলেন, সমস্ত জীবনের সুখ শান্তি বিলিয়ে দিলেন একটি জাতির স্বাধীনতার জন্য অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। তাকে সেই বাঙালিরা খুন করল হত্যা করল কেন?’ এই প্রশ্ন রাখেন প্রধানমন্ত্রী।
সারাবাংলা/এনআর/একে
আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বঙ্গমাতা শেখ হাসিনা