১৬৭৬ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন, আদায় ১৪৩ কোটি
৮ আগস্ট ২০২১ ২১:০৭
ঢাকা: সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০২০-২০২১) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদফতর ২৩৩টি ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ তদন্ত করেছে। এতে প্রায় ১ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। জরিমানাসহ এই ফাঁকির টাকা আদায় হয়েছে প্রায় ১৪৩ কোটি। অর্থবছর শেষে ভ্যাট গোয়েন্দার কার্যক্রম মূল্যায়নে এই চিত্র উঠে এসেছে।
রোববার (৮ আগস্ট) বিকেলে সারাবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান।
তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু করদাতাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা প্রতিরোধ, বিদ্যমান আইন ও বিধির পরিপালন নিশ্চিতকরণসহ ভ্যাট আহরণে সহায়ক ভূমিকা পালনে আমরা কাজ করছি। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরুর মধ্যেই করোনার বিস্তারের সময়টিতে ভ্যাট ফাঁকি রোধে বড়ধরনের কোনো অভিযানে নামেনি ভ্যাট গোয়েন্দা সংস্থা। পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ধীরে ধীরে চালু হওয়ায় এনবিআরের নির্দেশে ভ্যাট ফাঁকি রোধে মাঠ পর্যায়ের রাজস্ব আহরণকারী দফতরের পাশাপাশি গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করা হয়। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণও মিলেছে।’
মইনুল খান জানান, গতবছরের হিসাব অনুযায়ী অডিট সম্পন্ন করা হয় ১৪১টি প্রতিষ্ঠানের। ৮৩ ধারায় অভিযান করা হয় ৯২টি প্রতিষ্ঠানে। গত অর্থবছরে রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অভিযান করাসহ নিয়মিত অডিটের মাধ্যমে প্রায় বিপুল পরিমাণ ফাঁকি উদঘাটন করেছে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদফতর। এ তালিকায় ব্যাংক, বীমা, অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ভ্যাট গোয়েন্দা দফতরের চার্টার অব ফাংশন অনুযায়ী নিয়মিত অডিট পরিকল্পনা প্রণয়ন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনা বাস্তবায়ন, গোয়েন্দা তথ্য ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিশেষ অডিট ও অনুসন্ধান কার্যক্রমের মাধ্যমে সর্বমোট ১৪১টি প্রতিষ্ঠানের অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। এই অডিটের মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটিত হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান অডিটে উদ্ঘাটিত টাকা স্বপ্রণোদিত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে।
তিনি আরও জানান, অডিটে সর্বোচ্চ রাজস্ব উদঘাটিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৪৬২ কোটি ২৮লাখ, প্রিমিয়ার ব্যাংক লি ১৪৫ কোটি ১৬ লাখ, ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংক লি. ১২৫ কোটি ৭৩ লাখ, বেসিক ব্যাংক লি. ১০০ কোটি ৫১ লাখ, জনতা ব্যাংক লি. ৪৯ কোটি ৫২ লাখ, আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি. ৪৮ কোটি ৮৪ লাখ, সোনালী ব্যাংক লি. ৪৪ কোটি ২৭লাখ, আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লি. ২৬ কোটি ৩৭ লাখ, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স লি. ২৫ কোটি ২৮ লাখ, ডিপিএসএসটিএস স্কুল ২৩ কোটি ০৩ লাখ, কারিশমা সার্ভিসেস লি. ২০ কোটি ৯৭ লাখ, লংকা বাংলা ফাইন্যান্স লি. ২০ কোটি ৬০ লাখ, এলিট পেইন্ট অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লি. ২১ কোটি ২০ লাখ টাকাসহ তালিকায় রয়েছে অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান।
এদিকে ভ্যাট গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, নিজস্ব জনবল, সোর্স, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, ব্যক্তি বিশেষের গোপন অভিযোগপত্র ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগের প্রাথমিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে সত্যতা যাচাই করে ভ্যাট গোয়েন্দা সরেজমিনে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও দলিলাদি জব্দকরণের মাধ্যমে প্রায় ১৩৪ কোটি ৬ লাখ টাকা উদঘাটিত হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ অভিযানের মাধ্যমে উদ্ঘাটিত ফাঁকির ক্ষেত্রে স্বপ্রণোদিত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় ৮ কোটি ৩ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে। এই অভিযানে সর্বোচ্চ রাজস্ব উদঘাটিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- আকতার ফার্নিচার ৩৯ কোটি ৬৩ লাখ, মোহাম্মদী ট্রেডিং ৩৮ কোটি ৯৯ লাখ, চারুতা প্রাইভেট লিমিটেড ৩০ কোটি ৩৬ লাখ, উজালা পেইন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ ২৭ কোটি ১৪ লাখ, হোটেল লেকশোর সার্ভিস লি. ১৬ কোটি ৯৮ লাখ, ফুড ভিলেজ প্লাস ১৩ কোটি ৫২ লাখ, ফুড ভিলেজ লিমিটেড ১২ কোটি ৯৩ লাখ, ডিবিএল সিরামিক্স লি. ৬ কোটি ৮৯ লাখ, খান কিচেন লি. ৩ কোটি ৬০ লাখ, সুং ফুড গার্ডেন ৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকাসহ তালিকায় রয়েছে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান।
এনবিআরের ভ্যাট অনলাইন সূত্রে জানা যায়, ভ্যাট গোয়েন্দাদের জরিপ কার্যক্রম পরিচালনার পর মাঠ পর্যায়ে ভ্যাট নিবন্ধন গ্রহণের হার মাসে প্রায় চার গুণ বেড়েছে, যার ইতিবাচক প্রভাব চলতি অর্থবছরে রাজস্ব খাতে লক্ষ্য করা যাবে বলে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদফতর মনে করে।
ভ্যাট ফাঁকি রোধে নিত্যনতুন কৌশল উদ্ভাবন, কর্মকর্তাদের উদ্ধুদ্ধকরণ ও অভিন্ন নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গেল অর্থবছরে অধিদফতর নিরীক্ষা, তদন্ত ও অনুসন্ধানের মাধমে মোট ১ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন করেছে, যার বিপরীতে ১৪৩ কোটি টাকা সরকারি কোষাগার তাৎক্ষণিকভাবে জমা হয়। এ উদঘাটন বিগত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ বেশি এবং তাৎক্ষণিক আদায় প্রায় ২ দশমিক ৫ গুণ বেশি। উল্লেখ্য ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন হয়েছিল ৩১৯ কোটি টাকা, আদায় হয়েছিল প্রায় ৫৭ কোটি টাকা।
সারাবাংলা/এসজে/পিটিএম