পাহাড়ে থামছেই না পাথর উত্তোলন, পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা
৯ আগস্ট ২০২১ ১০:১১
রাঙ্গামাটি: পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিতে ঝিরি-ঝর্ণা আর পাহাড় কেটে পাথর উত্তোলন থামছেই না। অবৈধভাবে ঝিরি-ঝর্ণার পাথর উত্তোলনের ফলে নষ্ট হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর। পাহাড় কেটে বনের পাথর সংগ্রহে ঘটছে পাহাড় ধসের ঘটনা। এ অবস্থায় পরিবেশ বিপর্যয় ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি তিন জেলাতেই।
পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, পাথর উত্তোলনসহ পরিবেশবিরোধী অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটগুলো ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে থাকায় প্রশাসন নীরব ভূমিকায় রয়েছে। তবে স্থানীয় প্রশাসন বলছে, পাথর উত্তোলনের সঙ্গে স্থানীয় জনগণ জড়িত হয়ে পড়ায় রোধ করা কঠিন হচ্ছে। তারা স্থানীয়দের পাথর উত্তোলনে নিরুৎসাহিত করার জন্য কাজ করছেন।
রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়ন- বেশিরভাগ পরিবারই ঝর্ণা আর ঝিরির পানি দিয়ে পানির চাহিদা পূরণ করেন। কয়েকবছর আগেও ঘাগড়া ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি পাড়ায় অবস্থিত ঘাগড়া ঝর্ণায় যাওয়ার পথে অসংখ্য পাথর দেখা যেত।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে সরেজমিন দিয়ে দেখা গেছে, ঝিরি পথে আগের মতো পাথরের সংখ্যা তেমন নেই। এছাড়া ঝিরি পথটিতে পানি শুকিয়ে গ্রামীণ রাস্তা তৈরি হয়েছে। সেই রাস্তাতেই দেখা যাচ্ছে ট্রাক চলাচলের চিহ্ন। এছাড়া ঝিরি পথের দুপাশে রয়েছে ছোট ছোট পাথরের স্তূপ।
স্থানীয়রা জানান, বিক্রির জন্য পাড়ার বাসিন্দারা ঝিরির পাথর উত্তোলন করে ছোট-বড় স্তূপ তৈরি করেছে। আর পাথর পরিবহনের জন্য ছোট ট্রাক চলাচলের কারণে ঝিরিপথটি গ্রামীণ সড়কে পরিণত হয়েছে।
ঘাগড়া ঝর্ণা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার সামনে গিয়ে দেখা গেছে, পাহাড় কেটে পাথর উত্তোলনের দৃশ্য। তবে ঘটনাস্থলে কাউকে পাহাড় কাটতে দেখা না গেলেও পাহাড় কাটার চিহ্ন আর পাশে পাথরের ছোট ছোট স্তূপ দেখেই বোঝা গেছে যে দুয়েকদিনের মধ্যেই কাটা হয়েছে এসব পাহাড়। পাশাপাশি ছড়া থেকে পাথর উত্তোলনের চিহ্নও সেখানে দেখা গেছে।
সেখানকার স্থানীয় ১০-১৫ জন অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও কারা এই পাথর উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত সে বিষয়ে মুখ খোলেননি তারা। তবে পাথর বেচাকেনার বিষয়টি অনেকেই স্বীকার করেছেন। পুরো এলাকাটিতে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। আশেপাশে কোন পাহাড়ি পরিবার নেই বলে জানিয়েছে তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক কিশোর সারাবাংলাকে বলেন, কারা পাথর কিনে নিয়ে তা যায় জানি না। তবে দেখি রাতে বা দুপুরে জিপগাড়ি এসে পাথর কিনে নিয়ে যায়, কাঠ নিয়ে যায়।
মো. হানিফ নামে এক স্থানীয় বলেন, বর্ষার তুমুল স্রোতে যার বাড়ির পিছনে পাথর এসে জমা হয়, সেটা তার পাথর। এই এলাকার সবাই। আমরা পাথর উত্তোলন করি। যে যা পাই তাই ফুট হিসেবে বিক্রি করি। পাথর ভালো হলে প্রতিফুট ৫০ টাকা করে বিক্রি করি আর দুই নম্বর হলে ৩০ টাকা করে বিক্রি করতে হয়। তবে কোনটা এক নম্বর কোনটা দুই নম্বর সেটা আমরা জানি না, ব্যাপারিরা সেটা বুঝে কিনে নেয়। তবে কারা এই পাথর ব্যাপারি সে বিষয়ে বলতে নারাজ তিনি।
ফাতেমা বেগম নামে এক নারী বলেন, আমাদের ছড়ায় আগে পানি থাকত, এখন শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। পানি আনতে হয় এক কিলোমিটার দূরে ব্রিজের নিচ থেকে। বর্ষায় স্রোতে যখন পানির সঙ্গে পাথর আসে, তখন এলাকার সবাই পাথর তুলতে নামি ছড়ায়। শুষ্ক মৌসুমে যা অল্পসল্প পড়ে থাকে তা তুলি। তবে যারা পাথর চিনে তারা এক নম্বরটা তুলে আর আমরা এক নম্বর-দুই নম্বর যা পাই সব পাথরই তুলি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৩ নম্বর ঘাগড়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান জগদীশ চাকমা বলেন, ছড়া থেকে পাথর উত্তোলন করার কারণে পানির সব উৎস শেষ। এখন শুষ্ক মৌসুমে এলাকায় তীব্র পানি সংকট দেখা দেয়। পাথর উত্তোলন বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে এই সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।
তবে কারা এই পাথর উত্তোলনের সিণ্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মুখ খুলতে চাননি। তিনি বলেন, ‘কারা এই পাথর ব্যাপারি তা জানি না। যখনই মানুষের চলাচল কম থাকে, তারা তখনই পাহাড় কেটে পাথর উত্তোলন করে। ছড়ার পাথরতো এখন নেই বললেই চলে।’
পরিবেশকর্মী সৈকত রঞ্জন সারাবাংলাকে বলেন, কাপ্তাই হ্রদের অবৈধ দখল, বনভূমি উজাড়ের পাশাপাশি পাহাড়ের ঝিরি-ঝর্ণা রক্ষায় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের উদাসীনতা বরাবরের মতই রয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয়ে এমন নির্লিপ্ততা আমাদের হতাশ করে। বিশেষত ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই পাথর উত্তোলন ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। এরা ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে থাকার কারণে প্রশাসন কিছুটা নির্বিকার থাকে।
রাঙ্গামাটির পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফজলে এলাহী সারাবাংলাকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ক্রমান্বয়ে বৃক্ষনিধনের পাশাপাশি ঝিরি-ঝর্ণার পাথর উত্তোলনও থেমে নেই। এতে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে প্রতিনিয়ত। পানির উৎস নষ্ট ও পাহাড় ধসের ঘটনা বেড়েছে সাম্প্রতিকসময়ে। আবার এসব অপতৎপরতার সঙ্গে যারাই জড়িত, তারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় রয়েছে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রশাসনকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। এছাড়া স্থানীয় যেসব জনপ্রতিনিধিরা আছেন তাদেরকেও পরিবেশ বাঁচানোর উপলব্ধি থেকেই এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
পাথর উত্তোলনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয় ও পানির উৎস নষ্ট হওয়ার কথা বলছেন রাঙ্গামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় এখানে ঝিরি-ঝর্ণাগুলোতে অনেক পাথর রয়েছে। তবে অবাধে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে দিনদিনই পানির উৎস নষ্ট হচ্ছে। নির্বিচারে পাথর উত্তোলনে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি পাহাড়ের পানির উৎসগুলোও হুমকিতে পড়েছে।’
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ঘাগড়া এলাকায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের বিষয়টি নিয়ে আমরা অবগত হয়েছি। পাথর চোরচক্রের বিরুদ্ধে আমরা অবশ্যই আইননানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব। তবে স্থানীয় লোকজন পাথর উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে। তাই পাথর উত্তোলন বন্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসন যৌথভাবে কাজ করছে।
সারাবাংলা/এসএসএ