কয়রাকে নদী ভাঙন থেকে বাঁচাতে ১১শ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব
১০ আগস্ট ২০২১ ০৮:০৭
ঢাকা: খুলনার কয়রা। প্রায় প্রতি বছরই নদী ভাঙনের কবলে পড়ে সংবাদ শিরোনাম হয়ে ওঠে। বন্যা, আগাম বন্যাসহ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এই অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। কপোতাক্ষ নদ ও শাকবাড়িয়া নদীর তীরবর্তী এই অঞ্চলকে জোয়ারের পানি ও লবণাক্ততা থেকে সুরক্ষা দিতে সত্তরের দশকে নির্মাণ করা হয়েছিল পোল্ডার। অর্থাৎ বেড়ি বাঁধ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল এলাকাটি। প্রায় পাঁচ দশকে রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতির কারণে সেই পোল্ডার এলাকার অনেক অবকাঠামোই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। পাঁচ দশক পর সেই পোল্ডার পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর আওতায় কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ও উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নে অবস্থিত ১৪/১ নম্বর পোল্ডারটির পুনর্বাসন করা হবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত এই প্রকল্পটির শিরোনাম ‘খুলনা জেলার পোল্ডার নং১৪/১ পুনর্বাসন’। ১ হাজার ১৭২ কোটি ৩১ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে ১৪/১ নম্বর পোল্ডারের বাঁধ ও অন্যান্য অবকাঠামো পুনরুজ্জীবিত করা যাবে। এতে প্রকল্পভুক্ত এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ সুবিধা ও লবণাক্ততা দূর করা সম্ভব হবে। এর ফলে ওই এলাকার কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হবে, যা এলাকার জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয় চলতি বছরের ২৪ মার্চ। ওই সভায় কিছু সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো প্রতিপালন করায় প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উপস্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশন সূত্র বলছে, যেকোনো একনেক বৈঠকে প্রকল্পটি উপস্থাপন করা হবে। অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে শুরু হয়ে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ১৪/১ নম্বর পোল্ডারের অধীন তথা কয়রা উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন এলাকাটি দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে কপোতাক্ষ নদ এবং উত্তর ও পশ্চিমে শাকবাড়িয়া নদী দ্বারা বেষ্টিত। উপকূলবর্তী এই এলাকাটিকে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ থেকে রক্ষা ও কৃষি জমি সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে সত্তরের দশকে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পোল্ডারটি নির্মাণ করা হয়। ওই সময় বাঁধের উচ্চতা ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ দশমিক ৩ মিটার এবং বাঁধের প্রশস্ততাও ছিল ৪ দশমিক ৩ মিটার। বাঁধের দেশকূল দিকে স্লোপ ছিল ১:২, নদীকূলের দিকে স্লোপ ছিল ১:৩।
এদিকে, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসনের ঘাটতির পাশাপাশি জোয়ার-ভাটা ও ঢেউয়ের আঘাত এবং মৌসুমী নিম্নচাপের কারণে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও স্লুইস গেটসহ পোল্ডারের অধিকাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্রমাগত নদী ভাঙনের ফলে প্রকল্প এলাকার ঘরবাড়ি, হাট-বাজার, তীরবর্তী কৃষি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পোল্ডার এলাকাকে রক্ষা করতে হলে নদী ভাঙনে উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, এ সমস্যা সমাধানের জন্যই পোল্ডারটির বাঁধ, রেগুলেটর, স্লুইস গেট, খাল ইত্যাদি অবকাঠামো পুনর্বাসন করতেই বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিইজিআইএস, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট ও আইডব্লিউএমের সমন্বয়ে ২০২০ সালের নভেম্বরে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা করা হয়। এই কারিগরি কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব বিবেচনায় রেখে পোল্ডাটির বাঁধের উপরিসমতলের প্রশস্ততা আগের ৪ দশমিক ৩০ মিটারের বদলে ৫ মিটার করতে হবে। বাঁধের ক্রেস্ট লেভেলের উচ্চতাও প্রস্তাব করা হয়েছে ৫ মিটার। এর সঙ্গে নদীকূলের দিকে স্লোপ ১:৩ ও দেশকূলের দিকে স্লোপ ১:২.৫ ধরে নতুন করে নকশা করা হয়েছে পোল্ডারটির। সে অনুযায়ীই অন্যান্য অবকাঠামো পুনর্বাসনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রমের আওতায় ১৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার বাঁধ পুনর্বাসন করা হবে, ৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার স্লোপ প্রতিরক্ষা কাজসহ বাঁধ পুনর্বাসন এবং ১০ দশমিক ৯৭ কিলোমিটার নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ করা হবে। এছাড়া ৪ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার বিদ্যমান নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ মেরামতসহ বাঁধ পুনর্বাসন, ৬ দশমিক ১৫৫ কিলোমিটার নিষ্কাশন খাল পুনঃখনন, চারটি রেগুলেটর প্রতিস্থাপন, ১৩টি আরসিসি ইনলেট, ২ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং এবং ৯২ দশমিক ৯৩ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে।
প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস পরিকল্পনা কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের প্রায় ২ হাজার ৯৩৩ হেক্টর এলাকার ঘরবাড়ি, হাটবাজার, নদী তীববর্তী কৃষি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো নদীভাঙন থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। একইসঙ্গে পোল্ডার এলাকায় লোনা পানি প্রবেশ রোধ করা সম্ভব হবে।
সারাবাংলা/জেজে/টিআর