চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমণ্ডিত সিআরবিতে হাসপাতাল প্রকল্প বাতিলের জন্য স্মারকলিপির পর এবার সংবাদ সম্মেলন করেও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছে আন্দোলনকারী সংগঠন নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম। সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে সংগঠনের চেয়ারম্যান ড. অনুপম সেন বলেছেন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ঘোষিত সিআরবির প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে হাসপাতাল নির্মাণের পক্ষ যারা নেবেন, তারা চট্টগ্রামের তথা দেশের শক্র হিসেবে গণ্য হবেন।
মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ‘বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে’ নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিআরবি থেকে সরিয়ে অন্যত্র হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের দাবি জানানো হয়েছে। এতে লিখিত বক্তব্য পড়েন সংগঠনের সদস্য সচিব ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল।
একুশে পদকজয়ী শিক্ষাবিদ অনুপম সেন বলেন, ‘সিআরবি রক্ষায় চট্টগ্রামের মানুষ তথা সারাদেশের মানুষ এখন ঐক্যবদ্ধ। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চাই। হাসপাতাল হোক সেটা আমরা চাই, তবে সেটা কোনোভাবেই সিআরবিতে নয়। সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করা হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়, রেলওয়ের পক্ষে ২০১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে একটি হাসপাতাল ও কলেজ নির্মাণের জন্য নোটিশ দিয়ে ইনভাইটেশন চাওয়া হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয় যে, হাসপাতালটি চট্টগ্রামে রেলওয়ের যে কোনো জায়গায় নির্মাণ হবে, যেখানে সুনির্দিষ্ট কোনো জায়গার উল্লেখ নেই। পরবর্তীতে তথ্য-উপাত্ত গোপন করে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে রেলওয়ে চুক্তিবদ্ধ হলে হাসপাতালের স্থান হিসেবে সিআরবি এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়, যা বেআইনি। এ কারণে চট্টগ্রামবাসী আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছে।
ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল বলেন, ‘হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের স্থান হিসেবে সিআরবি এলাকাকে বাছাইয়ের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সঠিক তথ্য দেওয়া হয়নি। অনেক কিছু গোপন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক জানানো হলে, তিনি নিশ্চয় হাসপাতাল প্রকল্প রেলওয়ের অন্য কোনো জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেবেন।’
এর আগে সিআরবিতে হাসপাতাল প্রকল্প বাতিলের দাবিতে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে চিঠি এবং পরে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্মারকলিপি দেয় নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইফেটিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান অপিনিয়নের (ইকো) গবেষণায় পাওয়া তথ্য তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সিআরবিতে ১৯৭টি উদ্ভিদ প্রজাতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বড়গাছ ৭৪ প্রজাতির ও মাঝারিগাছ ৩৭ প্রজাতির, গুল্ম প্রজাতি ৬৭টি এবং লতা জাতীয় উদ্ভিদ ১৪ প্রজাতির, বিপন্নপ্রায় ৯টি প্রজাতির গাছও আছে।
সিআরবিতে ঔষধি গাছ মস, টোনা, অর্জুন, লজ্জাবতী, আপাং, নিশিন্দা, টগর, সঞ্জিনা, দেবকাঞ্চন ও মাটিসুন্দার, বিলুপ্তপ্রায় দুধকুরুস, বাঁকা গুল, সোনাতলা, গুলঞ্চ, সর্পগন্ধা, বকুল, পিতরাজ, দুরুষ-এর দেখা মিলেছে। সিআরবির বৃক্ষরাজি সংরক্ষণ করা না হলে ভবিষ্যতে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। শতবর্ষী রেইনট্রিগুলোতে অনেক ধরনের পরগাছা, যেমন- ছত্রাক, শৈবাল, অর্কিড ও পরজীবীর বসবাস। এসব প্রজাতির সংখ্যা দেড়শতাধিক হবে। এছাড়া সিআরবি ব্যাঙ, বহুবিধ সাপ ও বিভিন্ন পাখ-পাখালির অভয়রণ্য। এখানে হাসপাতাল নির্মাণ হলে জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়বে এবং তা হবে দেশের সংবিধান ও পরিবেশ আইন বিরোধী আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সিআরবিতে আয়োজন করা হয় পহেলা বৈশাখের সার্বজনীন অনুষ্ঠান, বসন্ত উৎসব, বলী খেলা। ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরসহ বিভিন্ন দিবসে মানুষ এখানে জড়ো হন। সব মিলিয়ে সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে সিআরবি এলাকা। হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবিত স্থানটিতে রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুর রব, শহীদ শেখ নজির আহমদ, শহীদ এমএ মনোয়ার হোসেন, বিমল সিং, ফখরুল আলম, মো. সিরাজউদ্দিন, আলী নূর চৌধুরী, মহিউদ্দিন, নুরন্নবী চৌধুরী ও গঙ্গারামের স্মৃতিস্তম্ভ। শহীদ আবদুর রবের পৈত্রিক বাসস্থান এখানে, সেই বাসা থেকেই তিনি যুদ্ধে যান। যুদ্ধের ইতিহাস মুছে দিয়ে এখানে বাণিজ্যিক হাসপাতাল হতে পারে না।
অনুপম সেন বলেন, ‘যথাযথ উদ্যোগের অভাবে নান্দনিক শহর চট্টগ্রামের সবুজ প্রকৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। শহরের অনেক উন্মুক্ত পরিসর একে একে হারিয়ে গেছে। এখন একমাত্র অবশিষ্ট রয়েছে সিআরবি। এটাও যদি রক্ষা করা না যায় তাহলে আগামী প্রজন্মের জন্য ঐতিহ্যবাহী আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তাই যে কোনো মূল্যে সিআরবিকে রক্ষা করতে হবে। চট্টগ্রামবাসীকে সাথে নিয়ে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধ করবো।’
সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুচ, একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, অধ্যাপক হোসাইন কবির, কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল, চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বাবু, আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান, গণজাগরণ মঞ্চ, চট্টগ্রামের সমন্বয়কারী শরীফ চৌহান, প্রাণ-প্রকৃতি গবেষক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, আইনজীবী ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, কবি স্বপন মজুমদার, কবি ও সাংবাদিক শুকলাল দাশ এবং সাবেক ছাত্রনেতা নুরুল আজিম রণি ছিলেন।