ন্যাজাল স্প্রে ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও উৎপাদন দেশেই
১২ আগস্ট ২০২১ ২৩:১২
ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশেই ন্যাজাল স্প্রে ভ্যাকসিন তৈরি হবে। সুইডেনের কেরোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনটির ৩০ কোটি ডোজ বাংলাদেশেই উৎপাদন করা হবে— এ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকও সই করা হয়েছে। শুধুমাত্র উৎপাদনই নয়, খুব দ্রুতই বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) অনুমতি নিয়ে ভ্যাকসিনটির মানবদেহে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ শুরু হতে যাচ্ছে বাংলাদেশেও।
সেপ্টেম্বরেই শুরু হতে পারে এই ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম পর্ব। এই পর্ব শেষে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বও বাংলাদেশে শুরু করা হবে ধারাবাহিকভাবে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষে সন্তোষজনক ফলাফল নিয়ে এটি বাংলাদেশেই উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা। যেন শুধুমাত্র দেশের মানুষদের উপরেই প্রয়োগ নয়, বরং উৎপাদন করে বিদেশেও ভ্যাকসিন রফতানি করতে পারে বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাপী করোনার নতুন ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে ব্যাপক উদ্যোগ দৃশ্যমান এবং প্রচলিত ভ্যাকসিনগুলোর উপকারিতা-অপকারিতা নিয়েও চলছে ব্যাপক আলোচনা। এর মধ্যেই সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট নভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর নতুন এক ভ্যাকসিনের প্রোটোটাইপ উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছে। ডিএনএ ভ্যাকসিন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে উদ্ভাবিত নতুন এই ভ্যাকসিনটি দামে কম, উৎপাদন সহজ এবং নিরাপদ বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা।
চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যাকসিনটির অ্যানিম্যাল ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করা হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ন্যাচার জার্নালে। এই জার্নালটিতে প্রকাশক হিসেবে আছেন ইঙ্গা জারগট, লিও হ্যাঙ্ক, ডানিয়েল যে শেউয়ার্ড, লরা পেরেজ, বেন মুরেল, জেরার্ড এম ম্যাকলার্নি, পিটার লিজেস্ট্রম। মূলত এই ভ্যাকসিনটি পিটার লিলেস্ট্রম ল্যাবের ড. ইঙ্গা জারগট ও ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের জেরাল্ড ম্যাকলার্নির প্রচেষ্টায় শুরু করা হয়।
জার্নালে প্রকাশিত ফলাফলে জানানো হয়েছে, ইঁদুরের ওপর চালানো গবেষণা থেকে গবেষকরা দেখেছেন, এই ভ্যাকসিন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সক্ষম। প্রাথমিকভাবে ডিআরইপি-এস নামকরণকৃত এই ভ্যাকসিন গ্রহীতার শরীরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আরএনএ রিপ্লেকেশন শুরু করবে এবং নিজে থেকেই আরএনএ উৎপাদন বাড়াবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ডিআরইপি-এস ভ্যাকসিনটি ইঁদুরের দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম। বিশেষ করে, এক ডোজ নেওয়ার পরই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন গ্রহীতার দেহে শক্তিশালী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এ ব্যাপারে গবেষকরা আরও জানিয়েছেন, এই ভ্যাকসিনের আলাদা দুইটি ডোজ শরীরে আলাদা ধরনের প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই ভ্যাকসিন পরিবহন এবং সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নিম্ন তাপমাত্রা রক্ষা করতে হবে না। এছাড়াও, ভাইরাসের নিত্য নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এই ভ্যাকসিন দ্রুত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। মূলত একটি আরএনএ সিকোয়েন্সেরই কয়েকটি কপি তৈরি করতে থাকবে, এমনটাই জানিয়েছেন গবেষকরা।
উদ্ভাবন প্রক্রিয়ায় থাকা এই ভ্যাকসিনটি যেহেতু নিজ থেকেই আরএনএ রিফ্লেকশনের কাজ করতে থাকবে, তাই এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম ডোজই কার্যকর হবে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হবে সামান্য বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। এর আগে, ডিএনএ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে উদ্ভাবিত এইচআইভি, ইবোলা, চিকনগুনিয়া এবং এইচপিভির ভ্যাকসিনও উদ্ভাবন করা হয়েছে। যা এখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে।
সম্প্রতি কেরোলিনস্কা ইনস্টিউটের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে এই কাজে সহায়তা করেন প্রবাসী বাংলাদেশীরাও। ভ্যাকসিনটি বাংলাদেশে এনে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও উৎপাদনের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে একটি বিশেষজ্ঞ দল, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডা. আরিফুর রহমান। দেশে ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও উৎপাদনবিষয়ক কাজের সমন্বয়ের জন্য গত ১৫ দিন সুইডেনে অবস্থান করছেন ডা. আরিফুর। সেখান থেকেই তিনি প্রতিদিন প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিচ্ছেন টিমের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে। টিমের অন্যান্য সদস্য হচ্ছেন- যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক মেট্রোপলিটন লার্নিং ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মাসুদুল হাসান, অধ্যাপক ডা. জিয়াউদদীন আহমেদ, অধ্যাপক ডা. চৌধুরী হাফিজ আহসান, মাহমুদ উস শামস চৌধুরী বাপ্পি ও সুইডেন প্রবাসী সৈয়দ শাহজাহান। এছাড়া এই টিমের সঙ্গেই বাংলাদেশ থেকে সহায়তা করছেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ, অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির
এবং অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী।
জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন সবাইকে ভ্যাকসিন পরিকল্পনার আওতায় আনা। এখন পুরো বিশ্বই ভ্যাকসিনের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর তাই ভ্যাকসিন নিয়ে সংকটও রয়েছে। আমরাও চেষ্টা করছি ভ্যাকসিন যোগাড় করার। কিন্তু এভাবে আসলে একসঙ্গে বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। তাই আমরা ভ্যাকসিন দেশেই তৈরি করার কথা ভাবছি।’
তিনি বলেন, ‘সুইডেনের কেরোলিনস্কা ইনস্টিউটের যে ভ্যাকসিনটি আছে সেটির প্রাথমিক ফলাফল খুবই ভালো। এটা মূলত একটি ন্যাজাল স্প্রে ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিন নাক ও মুখের মধ্য দিয়ে পাউডারের মত স্প্রে করে দেওয়া যাবে। এর জন্য কোনো আলাদা স্বাস্থ্যকর্মীর প্রয়োজন হবে না। যে কেউ চাইলে নিজেই ভ্যাকসিনটি নিতে পারবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই ভ্যাকসিনটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি যেকোনো তাপমাত্রায় রাখা যায়। তাই দেশ-বিদেশের সব জায়গায় সহজেই পাঠানো যাবে। আমরা যদি এই ভ্যাকসিনটির সবকিছু চূড়ান্ত করে আনতে পারি তবে খুব দ্রুতই উৎপাদনেও যেতে পারব। আর তখন দেশের মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পাশাপাশি আমরা বিদেশেও রফতানি করতে পারব।’
ডা. আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরাই যদি ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করি তখন কিন্তু আমাদের দেশের দরিদ্র গোষ্ঠীর মানুষকে স্বল্পমূল্যে কিংবা সরকার চাইলে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথাও ভাবতে পারবো। একই সঙ্গে আমরা যখন রফতানি করব, তখন সেটাও আমাদের দেশের প্রাপ্তির খাতাতেই যোগ হবে।’ খুব দ্রুতই এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে বলেও জানান ডা. আবদুল্লাহ।
জানতে চাইলে মুগদা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিন’র সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ভ্যাকসিনটি নিয়ে খুবই আশাবাদী। কারণ এর অ্যানিম্যাল ট্রায়ালের ফলাফল খুবই ভালো। আমরা প্রাথমিকভাবে এখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের চেষ্টা করছি। ফেজ-১ যদি আমরা শুরু করতে পারি তবে সেটি নভেম্বরের মধ্যেই শেষ করা যাবে। এরপরে আমরা ফেজ-২ ও ফেজ-৩ মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু অ্যানিম্যাল ট্রায়ালের ফলাফল খুবই ভালো তাই আশা করছি এই ভ্যাকসিনটি আমাদের দেশেও কার্যকর হবে। আর এই ভ্যাকসিন আমরা উৎপাদন শুরু করতে পারলে এটি আমাদের আরেকটি বিশাল সফলতা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যেই ভ্যাকসিনটির প্রথম পর্বের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এটি সেপ্টেম্বরে শুরু করা গেলে খুব দ্রুতই ফলাফল পাওয়া যাবে। পরবর্তী সময়ে আমরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় ফেজের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করব।’
জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক মেট্রোপলিটন লার্নিং ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মাসুদুল হাসান বলেন, ‘আমরা গত কয়েক মাস ধরে চেষ্টা চালিয়ে সুইডেনের কেরোলিনস্কা ইনস্টিউটের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে যোগাযোগ করে বাংলাদেশে তাদের উদ্ভাবিত নতুন ধরনের পেটেন্টেড করোনা ভ্যাকসিন বাংলাদেশে তৈরির জন্য সম্মত করিয়েছি। এ জন্য একটি সমঝোতা স্মারকও সই করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিনটির হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুতি পর্ব সম্পন্ন হয়েছে। এ মাসেই ভ্যাকসিনটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য আবেদন করা হবে বিএমআরসিতে। আশা করা যাচ্ছে, কয়েক মাসের মধ্যে এই যুগান্তকারী ভ্যাকসিন সারা বিশ্বে আগত নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টকে প্রতিরোধ করতে পারবে। বাংলাদেশ আপাতত তিনশ মিলিয়ন ডোজ তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছে।’ অদূর ভবিষ্যতে দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশে এটি রফতানির ব্যাপারে বাংলাদেশ ও সুইডেনের মুখ্য ভুমিকা থাকবে বলেও আশাবাদ জানান অধ্যাপক ডা. মাসুদুল।‘
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের প্রবাসী চিকিৎসকেরা এই প্রয়াসের সঙ্গে জড়িত। তাই আমরা এই ভ্যাকসিনকে বঙ্গবন্ধুর নামে উৎসর্গ করতে চাই। এজন্য এই ভ্যাকসিনের নাম বঙ্গবন্ধু-আইএসআর ভ্যাকসিন নাম দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।’ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অফিস এই সমস্ত প্রয়াস সম্পর্কে অবহিত আছেন বলেও জানান অধ্যাপক মাসুদুল।
উল্লেখ্য, কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সুইডেনের এই ভ্যাকসিনটি রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট লিস্টেও। কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে শরীরে দ্রুত অ্যান্টিবডি তৈরির ব্যবস্থা করা যাবে— এমন ভাবনা থেকে ন্যাজাল স্প্রে ভ্যাকসিন তৈরি কাজ শুরু হয়। এটি প্রতিষেধকের বিকল্প হিসেবেই ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। এ নিয়ে একটি হাইব্রিড অ্যান্টিবডি তৈরি করা হয়। এই হাইব্রিড অ্যান্টিবডি ইঁদুরের শরীরে গেলে ফুসফুসে করোনার সংক্রমণ সারাতে সক্ষম বলেই জানানো হয়েছে ন্যাচারে প্রকাশিত জার্নালে। শুধুমাত্র সুইডেনই নয়, ভারত বায়োটেকসহ বিশ্বের আরও বেশকিছু দেশে এই ন্যাজাল স্প্রে ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম
করোনাভাইরাস নজল স্প্রে বঙ্গবন্ধু-আইএসআর ভ্যাকসিন সুইডিশ ফর্মুলা