Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রতিবাদ হয়নি— এটি মিথ্যা প্রচারণা


১৫ আগস্ট ২০২১ ১০:৫৪

মুহাম্মদ শামসুল হক। জন্ম ১৯৫৬ সালে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছেন আপন ভাইকে। ছাত্র রাজনীতির পথেও হেঁটেছিলেন। কিন্তু থিতু হয়েছেন কালি ও কলমে। লেখালেখির পথ ধরে ১৯৭৭ সালে সক্রিয় সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি, ২০১৪ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে মনোনিবেশ করেছেন পুরোদস্তুর গবেষণায়। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধীনতার আন্দোলনের নানা অলিগলি, পথ-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ান আড়ালে থাকা ইতিহাসের খোঁজে। বের করে আনেন অপ্রকাশিত নানা ঘটনাবলী। ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণামূলক সাময়িকী ‘ইতিহাসের খসড়া’র সম্পাদক-প্রকাশক। স্বাধীনতার সংগ্রাম, একাত্তর থেকে পঁচাত্তর, তৎপরবর্তী প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখেছেন ১১টি বই।

বিজ্ঞাপন

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘসময় ধরে সামরিক-বেসামরিক শাসকগোষ্ঠী ও একশ্রেণির রাজনৈতিক মহল প্রচারণা চালিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর মতো অবিসংবাদিত নেতার হত্যাকাণ্ডের পর দেশে কোথাও কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হয়নি। তারা বোঝাতে চান, পঁচাত্তর সাল নাগাদ বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা অত্যন্ত কমে গিয়েছিল। তাই নিজ দলের নেতাকর্মীরাও তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেননি।

আসলেই কি তাই? সেই প্রচারণার সারবত্তা কতটুকু? সেই বিয়োগান্তক পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের ভূমিকা কী ছিল? দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি কেমন ছিল তখন? জনমানসেই বা বঙ্গবন্ধুহত্যা কতটা প্রভাব ফেলেছিল?

এসব বিষয় নিয়েই বিস্তর গবেষণা করেছেন মুহাম্মদ শামসুল হক। সেই অস্বাভাবিক বারুদচাপা সময়ের সাক্ষীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে তিনি লিখছেন ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা: প্রতিবাদের চাপা পড়া ইতিহাস’ শিরোনামে আরও একটি গ্রন্থ।

পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসক ও তাদের দোসর রাজনৈতিক মহলের যুগের পর যুগ ধরে চালানো প্রচারণায় সত্য আর মিথ্যার মিশেল কতটুকু— গবেষণায় পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সারাবাংলার কাছে তুলে ধরেছেন মুহাম্মদ শামসুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সারাবাংলার স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট রমেন দাশ গুপ্ত,  ছবি তুলেছেন ফটো করেসপন্ডেন্ট শ্যামল নন্দী

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডকে যারা ‘নিছক খুনোখুনি’ ভাবেন, তাদের ‘ইতিহাসের গভীর না যাওয়া বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন মুহাম্মদ শামসুল হক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল কিংবা যারা বঙ্গবন্ধুকে ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করেছিল, তারাই দিনের পর দিন এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং কয়েক প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে কিছুটা সক্ষমও হয়েছিলেন— এমনই মন্তব্য তার।

বিজ্ঞাপন

‘এটা নিছক খুন নয়, আমাদের ভাবতে হবে গভীরভাবে। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ও জঘন্য ঘটনা। এই হত্যাকাণ্ড শুধু একজন মানুষ হিসেবে শেখ মুজিবকে হত্যা করা নয়, এর পেছনে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ যে শক্তি নানাভাবে চক্রান্ত ষড়যন্ত্র করেছে সেই শক্তি, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং দেশের অভ্যন্তরের স্বার্থবাদী চক্রের সুগভীর চক্রান্ত আছে। তাদের সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের ফল হচ্ছে এই হত্যাকাণ্ড,’— বলেন শামসুল হক।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রতিবাদ হয়নি— এমন বক্তব্যকে একবাক্যে ‘মিথ্যা প্রচারণা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন এই গবেষক। তবে তিনি এ-ও মনে করেন, গণমানুষকে সংগঠিত করে তাৎক্ষণিকভাবে জাতির জনককে হত্যার জোরালো যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার ছিল, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু কেন সম্ভব হয়নি— তার জন্য সেসময়ের বৈরী পরিস্থিতি আর সুগভীর চক্রান্তকে কারণ মানছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘটনার আকস্মিকতায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ‘হতভম্ভ ও বিভ্রান্ত’ হয়ে পড়েছিলেন— এমনটি জানিয়ে শামসুল হক বলেন, ‘আমি নিজে ওই সময় সদ্য কৈশোরকাল পার করেছি। সেই সময়টুকু আমার নিজের চোখে দেখা। নিজের চোখেই দেখেছি— কেমন অস্থির অথচ গুমোট সময় পার করেছে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ। পরবর্তী সময়ে অনুসন্ধানেও জেনেছি, কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির অবস্থান ও সামরিক ব্যক্তির পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের আকস্মিকতায় সাধারণ মানুষসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর মধ্যে প্রথমে বিভ্রান্তি দেখা দেয়, এতে ভুল নেই। শুরুতেই মানুষ রাস্তায় নেমে আসেনি বা আসতে পারেনি— এটাও সত্য। কিন্তু কেন পারেনি, সেটার নেপথ্যের কারণ বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে।’

‘আবার একেবারেই যে প্রতিবাদ হয়নি বা মানুষ প্রতিবাদ করেনি বলা হচ্ছে, সেটাকে আমি মিথ্যা প্রচারণা বলছি। আমি অনেক তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটেছি। ওই সময়ের নেতাকর্মীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার পরবর্তী প্রকাশিতব্য বইয়ে তাদের বিষয়টি থাকবে। মোদ্দা কথা যেটি— বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর পাওয়ার পর দেশের অনেক জায়গায় সেদিনই প্রতিবাদ মিছিল হয়েছিল। তবে তখন দেশের যে পরিস্থিতি ছিল, তৎকালীন সামরিক কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষুর কারণে সারাদেশের পত্র-পত্রিকাগুলো এসব ঘটনা জানলেও না জানার ভান করে ছিল। এখনকার মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা টেলিফোন-মোবাইলের সুবিধা তখন ছিল না। ফলে প্রতিরোধ আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণ জনগণ বলতে গেলে তেমন কিছু জানতে পারেনি,’— বলেন তিনি।

তাৎক্ষণিক জোরালো প্রতিবাদ না হওয়ার কারণ সম্পর্কে শামসুল হক বেশ কয়েকটি কারণকে বিবেচনা করার তাগিদ দেন। তিনি বলেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের কর্মসূচি ছিল। এরপর থেকে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন কর্মসূচি ছিল। যেমন— নবগঠিত বাকশালের জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং পরদিন জাতীয় যুবলীগের নেতাকর্মীদের সম্মেলন ও পরিচিতি অনুষ্ঠান ছিল। এ উপলক্ষে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের জেলা গভর্নর, সংসদ সদস্য এবং বাকশাল, জাতীয় যুবলীগ, জাতীয় ছাত্রলীগের (সব কমিটি আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত) জেলা পর্যায়ের প্রায় শীর্ষ নেতা এবং যুবলীগ-ছাত্রলীগে তাদের ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা অবস্থান করছিলেন ঢাকায়।’

‘চট্টগ্রামের নেতাদের মধ্যে জাকেরুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল হারুণ, এম এ মান্নান, আবু ছালেহ, এস এম ইউসুফ, এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, শামসুদ্দিন আহমদ, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীসহ আরও অনেকেই ঢাকা অবস্থান করছিলেন। অর্থাৎ সাংগঠনিকভাবে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলা বা প্রতিরোধের ডাক দেওয়ার মতো নেতা জেলা পর্যায়ে ছিলেন না বলা চলে। এছাড়া ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখেছি, এরকম ঘটনার কোনো পূর্বাভাস সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ছিল না। তাই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সমন্বিত সশস্ত্র কিংবা মানসিক প্রস্তুতিও কারও ছিল না।’

‘এর অন্যতম কারণ বঙ্গবন্ধুকে বাঙালিদের কেউ হত্যা করতে পারে, সে ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর নিজের এবং সাধারণ মানুষের অবিশ্বাস। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র যে চলছিল তা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্য স্তরের একাধিক কর্মকর্তাসহ দেশি-বিদেশি শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। নেতাদেরও কেউ কেউ তাকে ৩২ নম্বর বাড়ির নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে গণভবনে থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু জাতির পিতা হিসেবে তিনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে তাকে মারার মতো কোনো ষড়যন্ত্র কেউ করতে পারে না— এটিই ছিল তার বিশ্বাস। সম্ভবত তিনি তার এই সরল বিশ্বাসের কারণে কারও কথাই শোনেননি এবং কোনো ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে প্রশাসন বা দলীয় নেতাকর্মীদের কোনো নির্দেশনা দেননি।’

অন্যদিকে ঘাতকচক্র, তৎকালীন সামরিক শাসকের মদতপুষ্টদের এবং পরবর্তীতে সামরিক শাসকদের চরম নিপীড়নমূলক পরিস্থিতিতে, অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান, একের পর এক বিয়োগান্তক পরিস্থিতিতে সারাদেশে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল— এমন প্রেক্ষাপট গবেষণায় তুলে এনেছেন শামসুল হক।

তিনি বলেন, ‘ঘাতকেরা সামরিক আইন ও কারফিউ জারির মাধ্যমে সভা-সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ভারি অস্ত্রসহ ট্যাংক ও সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে শহরজুড়ে টহল দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে। হুমকি দেওয়া হয়, কেউ রাস্তায় বের হলে সামরিক আইনে গ্রেফতার করে সাজা দেওয়া হবে। ঘাতকদের হিংস্র মনোভাবের খবর পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিংবা জীবনের মায়ায় ভীত হয়ে আত্মগোপন করছিলেন অনেকে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যারা প্রতিবাদ-প্রতিরোধের নির্দেশনা দিতে পারতেন, সেই নেতাদের মধ্যে বিশেষ করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনছুর আলী, কামরুজ্জামানসহ জাতীয় পর্যায়ের অনেক নেতা, এমনকি জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতারাও ছিলেন বন্দি অবস্থায় অথবা ঘেরাও হয়ে কড়া পাহারায়। এ অবস্থায় তাদের নির্দেশ-উপদেশ সাধারণ নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছানোর মতো পরিবেশ বা উপযুক্ত কোনো মাধ্যমও ছিল না তখন।’

‘এখনকার মতো এত টিভি চ্যানেল কিংবা দ্রুত যোগাযোগের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মোবাইল, ফেসবুক, মেসেঞ্জার তখন ছিল না। থানা পর্যায়ে তো বটেই, জেলা পর্যায়েও ল্যান্ড ফোন ছিল হাতেগোনা। জেলা-উপজেলায় (তখন থানা) যোগাযোগের জন্য সংযোগ পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। এ অবস্থায় রাজধানীর মূলকেন্দ্র গণভবন, রেডিও এবং সংবাদপত্র কবজা করা মানেই পুরো দেশটাকেই কবজা করা। ঘাতকচক্র অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পাল্টা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে— এমন সব দিক বন্ধ করেই তাদের কাজে হাত দেয়। ফলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকুণ্ঠ ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও পরস্পরের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগের অভাবে কান্নাকাটি ছাড়া সমন্বিত কোনো পদক্ষেপই নিতে পারেননি মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা।’

আবার আওয়ামী লীগের কিছু নেতার নেতৃত্বে সরকার গঠন নিয়েও দেশের মানুষ এবং নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন— এমনটিও বলছেন এই গবেষক। তিনি বলেন, ‘মোশতাক সরকার গঠন করলেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের কেউ কেউ, আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ স্বেচ্ছায় সেই সরকারে যোগ দিলেন। আবার অনেকে সশস্ত্র সৈন্যদের বন্দুকের নলের মুখে ভীত হয়েও যোগ দেন। দুর্বল চিত্তের নেতাদের এভাবে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে দেখে সাধারণ নেতাকর্মীদের অনেকেই মনে করেছিলেন, বিভ্রান্ত কিছু সৈনিক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও পরিস্থিতি ও সরকার আওয়ামী লীগেরই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কাজেই বঙ্গবন্ধু হত্যার শোক নিজেদের বয়ে বেড়াতে হলেও ঘাতকরা হয়তো রেহাই পাবে না— এমন ভেবেছিলেন তারা। এটি যে পাকিস্তানপন্থী মোশতাকচক্র ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রের ষড়যন্ত্রের চরম পরিণতি— এ কথা যখন সবাই বুঝতে পেরেছিলেন তখন ক্ষমতার কাঠামোসহ সার্বিক পরিস্থিতি ঘাতক ও সুবিধাভোগীদের অনুকূলে চলে গিয়েছিল।’

শামসুল হক তথ্য দিয়েছেন, হত্যাকাণ্ড পরবর্তী দুই-তিন মাসের মধ্যে দেশের বড় অংশজুড়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কর্মসূচি শুরু হয়ে দুই বছর ধরে চলছিল, যা অনেকটা একাত্তরের গেরিলা যুদ্ধের রূপ নিয়েছিল। এক্ষেত্রে তিনি সময়ে প্রতিবাদ ও সশস্ত্র প্রতিরোধে জড়িত ছিলেন— এমন অন্তত ৩০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, যাদের অধিকাংশই এখন আর জীবিত নেই। সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অনেক দলিলও তিনি সংগ্রহে রেখেছেন।

‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়ার পর পরিস্থিতির কারণে শীর্ষ পর্যায়ের কাউকে পাওয়া না গেলেও স্থানীয় নেতাকর্মীরা পরস্পর যোগাযোগের মাধ্যমে ওই দিনই চট্টগ্রাম শহর, বরগুনা ও কিশোরগঞ্জ, বেগমগঞ্জসহ এলাকায় প্রতিবাদ মিছিল বের করেছিল। ঘটনার প্রথম দিনেই চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র দখল করে জনগণকে প্রতিবাদে সামিল হওয়ার আহ্বান জানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু প্রবীণ নেতাদের কেউ কেউ অসংগঠিত ও নিরস্ত্র অবস্থায় এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় সম্মত না হওয়ায় উদ্যোগটি বাতিল হয়। তাদের মত ছিল, পর্যাপ্ত অস্ত্র ও জনবলসহ নিজেদের ক্ষমতা ও সামর্থ্যের বাইরে কিছু করতে যাওয়া ঠিক হবে না, হঠকারী হবে,’— বলেন শামসুল হক।

তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন-চার দিনের মাথায় মিছিল হয় ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে। ছাত্র কর্মীদের চেষ্টার ফলে ২০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন ও কলাভবন এলাকায় চলে সমাবেশ, মিছিল-স্লোগান। পরদিন আবারও মিছিল করতে গিয়ে সামরিক সরকারের সমর্থক ও পুলিশি হামলার শিকার হন ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে গোপনে সংগঠিত হয়ে ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকা ঘিরে মিছিল সমাবেশ, দেয়াল লিখন ও পোস্টারিংয়ের মাধ্যমে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ বাকশালভুক্ত ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এসময় ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা হয়। এতে শিক্ষার্থী ছাড়াও বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ অংশ নেয়। সেখানে উপস্থিত অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।’

ঢাকার বাইরের পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ওই দিন চট্টগ্রামের কয়েক জায়গায় মিছিলের আয়োজন করা হয়। মিছিল হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়া শেরপুর, পাবনা, ভৈরব, মুক্তাগাছায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। তবে সবকটি মিছিল-সমাবেশই পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বাধার কারণে সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে। কোথাও কোথাও সেনাবাহিনীর হামলার কারণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এসব আন্দোলনের প্রথম কয়েক মাসে চট্টগ্রামেও বাকশালভুক্ত ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের অনেকেই সক্রিয় ছিলেন।’

তবে এর মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি অংশ সশস্ত্র প্রতিরোধের কার্যক্রম শুরু করেন। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ইতিহাসে এর সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য আছে বলেও মনে করেন শামসুল হক। এক্ষেত্রে তিনি টাঙ্গাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের সিদ্দিকী এবং চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ ও এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন— ‘ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধের লক্ষ্যে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ময়মনসিংহের সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থান নেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী। একই রকম চিন্তা নিয়ে সংগঠিত হচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শহিদ শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও পরে জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য সৈয়দ নুরুল ইসলাম নুরুসহ বিভিন্ন কলেজ ও অন্যান্য অঞ্চলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। নভেম্বরে পর্যায়ক্রমে তারাও গিয়ে যোগ দেন কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে। গঠিত হয় জাতীয় মুক্তিবাহিনী। অল্পসংখ্যক বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক সদস্য নিয়ে এই বাহিনী কাজ শুরু করলেও গোপন সাংগঠনিক তৎপরতার ফলে এক বছরের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছয়-সাত হাজার, কারও কারও মতে আরও বেশি প্রতিবাদী যোদ্ধা এতে যুক্ত হন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিলেন একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা।’

চট্টগ্রামের নেতাকর্মীদের প্রসঙ্গে তিনি জানান, চট্টগ্রামের তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় যুবনেতা, একাত্তরে চট্টগ্রাম শহর গেরিলা বাহিনীর প্রধান মৌলভি সৈয়দ আহমদ, এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী (চট্টগ্রামের প্রয়াত সিটি মেয়র), যুদ্ধকালীন বিএলএফ’র পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার এসএম ইউসুফ তাদের অনুসারীদের সংগঠিত করেন। ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর কাটিয়ে সেনা-পুলিশের নজর এড়িয়ে তারা শহর ও থানা পর্যায়ে অনুগত কর্মীদের নিয়ে বিভিন্নস্থানে গোপন বৈঠকের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধমূলক নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধাসহ যুব ও ছাত্রলীগের কয়েকশ নেতাকর্মী ক্রমান্বয়ে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন।

‘এই প্রতিবাদের সঙ্গে যারা ছিলেন, তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছে। আমি জানতে পেরেছি, ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে আগ্রাবাদ পানওয়ালাপাড়ায় মৌলভি সৈয়দের আশ্রয়স্থলে একটি বৈঠক হয়। এতে মহিউদ্দিন চৌধুরী, এস এম কামাল উদ্দিন, সুলতানুল কবীর চৌধুরী, মোছলেম উদ্দিন আহমদ, মো. ইদরিস, কে এম সিরাজ, খালেকুজ্জামান, সুভাষ, লেয়াকত আলী খান, সন্তোষ, ইউনুস, এনামুল হক চৌধুরী, সফর আলীসহ আরও কয়েকজন ছিলেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে দেশের ভেতর প্রতিবাদ করা হবে এবং ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হবে। কারণ তাদের কাছে সরকারের বিরুদ্ধে অপারেশন করার মতো অস্ত্র ছিল না। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ও রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী টেরিবাজার কাটাপাহাড় লেনের শান্তি প্রেস থেকে একটি লিফলেট প্রকাশ করেন। সেটি চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়।’

‘পরবর্তী সময়ে আরও অনেক বৈঠক হয়েছে নগরীর বিভিন্ন এলাকায়। এস এম ইউসুফ ও তার অনুসারীদের প্রথম দিককার বৈঠক হয়েছে বহাদ্দারহাটে রেজাউল করিম চৌধুরীর (বর্তমান সিটি মেয়র) বাড়িতে। এরপর অভয়মিত্র ঘাটে একটি বাঁশের ঘরে, চেরাগি পাহাড় মোড় এস এম ইউসুফের এক আত্মীয়ের বাড়িতে, নন্দনকানন হরিশদত্ত লেনের জানে আলম ও দেওয়ান বাজার এলাকার আনোয়ারুল আজিমের বাসায় বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে এম এ জাফর, কাজী আবু তৈয়ব, চৌধুরী মাহবুবুর রহমান, গোলাম রব্বান, এম এ মান্নান, এ কে এম শামসুজ্জামান, আবুল কাসেম চিশতিসহ অনেকেই উপস্থিত থাকতেন।’

‘এভাবে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতির একপর্যায়ে ১৯৭৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রেফতার হয়ে যান। তবে কিছুদিন পর ছাড়া পেয়ে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এস এম ইউসুফ এবং মৌলভি সৈয়দও ছিলেন আত্মগোপনে। তারা তিনজনই আলাদাভাবে নভেম্বরের দিকে ভারতে চলে যান। সেখানে গিয়ে তারা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চেয়েছিলেন বলে আমি জানতে পেরেছি। কিন্তু ভারত কাদের সিদ্দিকীর বাইরে নতুন কোনো বাহিনীকে আলাদাভাবে সহায়তা দিতে পারবে না বলে জানায়। এ অবস্থায় তারা নিজেদের চেষ্টায় দেশের ভেতর মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য তারা আলাদাভাবে একাধিকবার গোপনে চট্টগ্রাম এসে নগর ও বিভিন্ন থানার গোপন স্থানে অবস্থান নিয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের অনুসারীদের নির্দেশনা দিয়ে আবার ভারতে চলে যান। আগরতলা ও কলকাতার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু হালকা অস্ত্র ও অর্থ যোগাড় করে চট্টগ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন।’

‘অন্যদিকে এস এম ইউসুফ প্রথম দিকেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কার্যকর সহযোগিতার আশ্বাস না পেয়ে ফিরে আসেন, তার সহকর্মীরাও ফিরে আসেন। এরপর তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম যাওয়া-আসার মাধ্যমে তার অনুসারীদের দিয়ে দুই দিকেই কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এম এ মান্নান (প্রয়াত মন্ত্রী) এস এম ইউসুফদের ভারতে যাওয়ার আগেই বলেছিলেন, অধিকাংশ এমপিসহ সিনিয়র নেতাদের অংশগ্রহণ ছাড়া ভারত একাত্তরের আদলে সহযোগিতা দেওয়ার সম্ভাবনা নেই।’

শামসুল হক জানালেন, মৌলভি সৈয়দ একটি কমান্ডো গ্রুপ নিয়ে লিবিয়া গিয়ে খুনিদের হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশের সেনা-বিডিআর ও পুলিশের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদী আন্দোলনের যোদ্ধাদের মধ্যে চলমান যুদ্ধে দুই পক্ষেরই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্য হতাহত হয়। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে নানাভাবে সহযোগিতা পাওয়ায় বাংলাদেশ বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সশস্ত্র সংঘর্ষ হয় মূলত কাদের সিদ্দিকীর পরিচালনাধীন জাতীয় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে। মৌলভি সৈয়দ, মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্নস্থানে কিছু স্থাপনায় বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ঝটিকা মিছিলের আয়োজন করে। মুসলিম লীগের চিহ্নিত কিছু ব্যক্তিসহ সরকারের দালাল হিসেবে সন্দেহভাজন অন্তত পাঁচ ব্যক্তিকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির মধ্যে আতঙ্কও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তারা।

‘তবে জানা গেছে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ যোদ্ধাদের রণকৌশলে কিছুটা ভিন্নতা ছিল। কারও কারও লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও তাদের মদতদাতা সামরিক কর্তৃপক্ষকে সশস্ত্র উপায়ে হটিয়ে নিজেদের কর্তৃত্বে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য প্রয়োজনে প্রতিবেশী দেশের সহযোগিতা ও সমর্থনের ওপরও অনেকটা নির্ভরশীল ছিলেন তারা। মৌলভি সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা এমন লক্ষ্য নিয়েই তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিলেন। আবার আরেকটি অংশের লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখার পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক বৈঠক-সমাবেশ, লিফলেট বিতরণ, দেয়াল লিখন ইত্যাদির মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করা, যেন জনমনে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটিয়ে দলকে সংগঠিত করে পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়া যায়। এমন চিন্তাভাবনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন এস এম ইউসুফের সমর্থকেরা। মৌলভি সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরী বৃহত্তর আন্দোলনে শরিক হতে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করলেও কৌশলগত বিষয়ে মতপার্থক্য থাকায় তারা কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে কাজ করতে রাজি হননি।’

ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলনেও প্রভাব পড়ে— এমনটি জানিয়ে শামসুল হক বলেন, ‘ভারতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার পরাজিত হয়ে মোরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়। মোরারজী সরকার জিয়াউর রহমান সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি করে। বাংলাদেশের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সব সহযোগিতা বন্ধ করে তাদের জোরপূর্বক বাংলাদেশের বিডিআর ও সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর মৌলভী সৈয়দ ভারতীয় বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে পুশব্যাকের শিকার হন। তাকে বাংলাদেশের সামরিক কর্তৃপক্ষ নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করে। মহিউদ্দিন চৌধুরী আগরতলায় গিয়ে জাতীয় মুজিব বাহিনী গঠন করেন। কিন্তু মোরারজী দেশাই সরকারের অসহযোগিতায় সেখানেও থাকতে পারেননি তিনি। ১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে আত্মগোপনে চলে যান। গোপনে লোকজন সংগঠিত করে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড জোরদার করেন।’

তবে মৌলভী সৈয়দের মতো দেশে ফেরত প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জিয়াউর রহমান সরকারের চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল জানিয়ে শামসুল হক বলেন, ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা কর হয়েছিল। সামরিক আইনে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছিল। মৌলভী সৈয়দকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এতে দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে, এমনকি সেনাবাহিনীর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল অংশের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষও বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। এরপর অবশ্য জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন ও হত্যা থেমে যায়। সামরিক সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে কোনো সংবাদ মাধ্যমে এসব তৎপরতার কোনো খবর প্রকাশ পায়নি। আন্দোলনের ইতিহাস চাপা পড়ে যায়। থেকে যায় সাধারণ মানুষের অগোচরে।’

‘তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়— অনেকটা গোপনে এবং বিক্ষিপ্তভাবে হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার এসব প্রতিবাদী আন্দোলনের ফলে সারাদেশে দিশেহারা, ঝিমিয়ে পড়া বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ব্যাপারে নতুন করে সাহস ও প্রাণ ফিরে পান। ফলে ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হলে সংশ্লিষ্ট সবাই দলকে পুনর্গঠনে উৎসাহী ও উদ্যোগী হন, যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সহজ হয়,’— এভাবেই উপসংহার টানেন মুহাম্মদ শামসুল হক।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শেখ মুজিব শেখ মুজিবুর রহমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর