বঙ্গবন্ধুর নামে মিলাদের আয়োজনই ছিল তাদের ‘অপরাধ’
১৫ আগস্ট ২০২১ ১২:০৮
ভৈরব (কিশোরগঞ্জ): ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট। ঘাতকদের নির্মম বুলেটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রয়াণের প্রথম বার্ষিকী। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর ক্ষত তখনো প্রবল। কিন্তু ক্ষমতায় তখনো চক্রান্তকারীরাই। সেই শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই জাতির পিতার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের ভৈরবের যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। বঙ্গবন্ধুর নামে কোরআন খতম ও মিলাদ-দোয়ার আয়োজন করেছিলেন। আর সেটিই সহ্য হয়নি ক্ষমতাসীনদের। বঙ্গবন্ধুর নামে কোরআন খতম ও মিলাদ-দোয়ার আয়োজন যেন অপরাধ! আর সেই ‘অপরাধে’ গ্রেফতার হয়েছিলেন যুবলীগ-ছাত্রলীগের ২২ নেতাকর্মী!
ভৈরব হাজী আসমত কলেজের শহীদ আশুরঞ্জন ছাত্রাবাসে মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করা হয়। স্থানীয় যুবলীগ, ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী এর আয়োজন করেছিলেন। আজ (রোববার) বঙ্গবন্ধুর ৪৬তম শাহাদতবার্ষিকীতে সেই দিনের স্মৃতিচারণ করেন ভুক্তভোগী কয়েকজন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা।
১৯৭৬ সালের ওই ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা হলেন— তৎকালীন থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আলম আক্কাছ, ছাত্রলীগ কর্মী আসাদুজ্জামান ফারুক (বর্তমানে সাংবাদিক), রুহুল আমিন, মাহাবুব, মতিউর রহমান, মফিজুর রহমান, মোশারফ হোসেন (জজ মিয়া), জিল্লুর রহমান জিল্লু, আসাদ মিয়া, আতাউর রহমান, আসাদুল হক শিশু, ফিরোজ মিয়া, দিলীপ চন্দ্র সাহা ও তার ভাই দিজেন্দ্র চন্দ্র সাহা, ফজলুর রহমান, আবদুল হামিদ, ইদ্রিছ মিয়া, মাহবুব আলম, রসরাজ সাহা, সুবল চন্দ্র কর, শাহজালাল হোসেন এবং আজমল ভূঁইয়া।
তারা জানান, এদিন বিকেল ৩টায় ছাত্রাবাসে হুজুররা কোরআন খতম শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর একদল পুলিশ ছাত্রাবাসটি ঘেরাও করে ফেলে। ভৈরব বাজারের হুলুদ পট্রির দুইতলায় ছিল ওই ছাত্রাবাস। প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন পুলিশ দুইতলায় উঠেই বলতে লাগল তোরা কিসের মিলাদ-কোরআন খতম করছিস? এত বড় সাহস তোদের। একথা বলেই ২২ জনকে বন্দুকের বাট দিয়ে পেটাতে শুরু করে। পুলিশের নির্যাতনে সেদিন অনেকেই রক্তাক্ত ও আহত হয়। পরে হুজুরদেরসহ ২২ জনকে আটক করে ভৈরব থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭৬ সালে ক্ষমতায় ছিল সামরিক সরকার। তৎকালীন সামরিক সরকারের নির্দেশেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল।
ভুক্তভোগীরা আরও জানান, থানায় নেওয়ার পর ১২ জন হুজুরকে মুছলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয় পুলিশ। আর ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ২২ জনকে ভৈরব থানার হাজতে আটকে রাখা হয়। পরদিন ১৬ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে আটকাদেশ দিয়ে তৎকালীন কিশোরগঞ্জ মহকুমা (বর্তমানে জেলা) আদালতে চালান করে দেওয়া হয়। আদালত তাদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠায়। তারপর কারা কর্তৃপক্ষ ফখরুল আলম আক্কাছ, আসাদুজ্জামান ফারুকসহ কয়েকজনকে কনডেম সেলে বন্দী করে রাখেন। বাকিদের কারাগারের একটি সেলে রাখেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর কয়েক বছর এদেশে কেউ তার নাম উচ্চারণ করতে পারত না। ঠিক এমন সময়ে সাহসিকতার সঙ্গে ভৈরবের ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের ২২ জন নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর প্রথম শাহাদতবার্ষিকীর আয়োজন করেছিলেন বলে জানান তারা।
সাবেক এই নেতারা আরও জানান, এ ঘটার পর দীর্ঘদিন তারা কারাগারে ছিলেন। কেউ ছয়মাস, কেউ আটমাস, কেউ এক বছর কারাভোগ করেন। এরপর তারা সবাই জামিনে মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পরও কয়েক বছর তাদের আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছিল। পরে ১৯৮০ সালে আদালত থেকে ওই মামলায় খালাস পান তারা।
বঙ্গবন্ধুর প্রথম শাহাদতবাষির্কী অনুষ্ঠানের আয়োজকদের মধ্যে অন্যতম ফখরুল আলম আক্কাছ। সেই দিনের স্মৃতির কথা স্বরণ করে সাবেক এই নেতা বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতাকে ঘাতকরা সপরিবারে হত্যা করেছিল। আর আমরাতো ছিলাম তুচ্ছ নেতা। আমরা সেদিন বঙ্গবন্ধুর নামে মিলাদ-দোয়াও পড়াতে পারলাম না। এই আয়োজনের জন্য পুলিশের নির্মম নির্যাতন ভোগ করলাম, জেল খাটলাম এক বছর। সেদিন আমাদের বড় অপরাধ ছিল বঙ্গবন্ধুর নামে মিলাদের আয়োজন করা।’
তৎকালীন ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান ফারুক (বর্তমানে সাংবাদিক) বলেন, ‘ঘটনার দিন পুলিশের নির্যাতনের কথা আজও ভুলতে পারি না। তখন সামরিক সরকারের এতটা ভয় ছিল এদেশে যে, বঙ্গবন্ধুর কোনো অনুসারী বা ভক্ত রাখা যাবে না। ওই সময়ে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা সামরিক সরকারের ভয়ে পালিয়ে ছিলেন। আর আমরা সাহসিকতার সঙ্গে সেদিন আয়োজনটি করেছিলাম।’
ওই দিন গ্রেফতার হওয়া আরেক ছাত্রলীগ নেতা রসরাজ সাহা বলেন, ‘সেই দুঃসময়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকীর আয়োজন করেছিলাম। আমার দুঃখ এখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় কিন্ত আমাদের কেউ স্মরণ করে না। ১৫ আগস্ট সরকারি বা দলীয় দাওয়াত পর্যন্ত আমরা পাই না। সরকার আমাদের মূল্যায়ন করুবে এটাই আমাদের দাবি।’
সারাবাংলা/এনএস